অবৈধ অস্ত্রে টান পড়ছে না

88

বিগত ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সাতসকালে নগরীর সদরঘাট নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। হত্যাকাÐের পর পুলিশের সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজে খুনিদের কয়েকজনকে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে দেখা যায়। গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণ মিলিয়ে এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১১ জন কারাগারে গেলেও প্রদর্শিত একটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রও পুলিশ উদ্ধার করতে পারে নি।
একইভাবে নগরীর ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর তা বাতিলের দাবিতে গতবছরের ১৯ সেপ্টেম্বর পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ওই মিছিল থেকে কয়েকজনকে প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। ঘটনার পর পুলিশ মো. ইমরান ও সাব্বির সাদিক নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার ও তাদের হেফাজত থেকে প্রদর্শিত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করলেও যুবলীগ নামধারী মাস্টারপুল এলাকার আবু মোরশেদ এখনও অধরাই রয়েছেন। ঘটনার সময় তার প্রদর্শিত রাইফেলটিরও কোনো হদিস পায়নি পুলিশ
এভাবে গত কয়েকবছরে নগরীতে সংঘটিত আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়া থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাÐে প্রদর্শিত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বেশিরভাগই পুলিশের জব্দ তালিকার বাইরেই রয়ে গেছে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কথিত ‘বড় ভাই’ ও তাদের অনুসারীদের কাছে মজুদ থাকা অবৈধ অস্ত্রে তেমন টান পড়েনি। এ কারণে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নামধারীদের অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে নগরীর খুলশী থানার দুই নম্বর গেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে তৈয়ব হোসেন (৩০) ওরফে রুবেল নামে ওয়ার্ড যুবলীগের এক নেতা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ ছয়জনকে আটক করলেও প্রদর্শিত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এখনও উদ্ধার করতে পারে নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রধারী গ্রেপ্তার হলেও তাদের কথিত ‘বড় ভাই’ শেষ পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে। তাই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদে তেমন একটা হেরফের হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের নিয়ন্ত্রকরা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুসারী কিংবা কোনও কোনও নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। ফলে, অস্ত্রের মজুদেও হাত লাগানো যায় না। গত দুই বছরে নগরী ও জেলার আলোচিত অর্ধশত খুনের মামলায় কিছু আসামি গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে প্রধান আসামি কিংবা কথিত বড় ভাইয়েরা। ধরা না পড়ায় রহস্যের কিনারা হয়নি কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার। উদ্ধার হয়নি ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র। ২০১৭ সালে নগরী ও জেলায় একশ’ ২৬টি এবং গত বছর একশ’ ৪০টি খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আলোচিত মামলা প্রায় অর্ধশত।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে উল্লেখ করে পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমরা হয়তো শহরের সব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারি নি। তবে, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা আমাদের থানা ও ডিবি পুলিশের নিয়মিত কাজ কিংবা চলমান প্রক্রিয়া। মাদক নির্মূলে যেমন আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছি, তেমনি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রধারীরও পার পাওয়ার সুযোগ নেই। পর্যায়ক্রমে তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, নগরীতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এলাকাভিত্তিক ‘বড় ভাইদের’ হাতে গড়ে উঠেছে অবৈধ অস্ত্রের বিশাল মজুদ। আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনে আত্মগোপনে চলে যাওয়া তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অনেকে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় ফিরে এসে ফের আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়। শক্তি বৃদ্ধির জন্য তারা সংগ্রহ করেছে অবৈধ অস্ত্র। এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক লেবাসধারী সেসব ‘বড় ভাইরা’ অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়েছে নিজ নিজ এলাকার উঠতি বয়সীদের হাতে। বড় ভাইয়ের প্রশ্রয় আর হাতে অস্ত্র পেয়ে কিশোর বয়সেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে স্কুল-কলেজ পড়–য়ারা। জননিরাপত্তা পড়েছে চরম হুমকিতে। নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় খোঁজ নিয়ে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, পুরনো সা¤্রাজ্যে ফিরে আসা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অনেকে নিজ নিজ ডেরায় অবস্থান নিয়ে এলাকার রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ‘বড় ভাইদের’ সাথে হাত মিলিয়েছে। আর বড় ভাইরা এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদা বা তোলাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকাÐে ব্যবহার করছে উঠতি বয়সীদের। স্কুল-কলেজ পড়–য়া উঠতি বয়সীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দেয়ায় তারা চোখের পলকেই বিপথগামী হচ্ছে। কথায় কথায় কিংবা তুচ্ছ ঘটনায়ও অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা যাচ্ছে উঠতি বয়সীদের। বিদেশি পিস্তল, রিভলবার, এসবিবিএল গানের পাশাপাশি দেশে তৈরি এলজিও তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে।
সিএমপির তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় শতাধিক অবৈধ অস্ত্র, ১৭টি ম্যাগাজিন, একশ’ সাত রাউন্ড গুলি ও দুইশ’ ৬৭ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার করেছে থানা ও ডিবি পুলিশ। একই বছরে র‌্যাব-৭ এর অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে তিনশ’ আটটি অস্ত্র, ৩১টি ম্যাগাজিন, ১০ হাজার একশ’ ৪৪ রাউন্ড গুলি ও কার্তুজ। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, নগরীতে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্রধারী রয়েছে। এসব অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা অস্ত্র বেচাকেনার পাশাপাশি খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাÐে অস্ত্র ভাড়াও দিচ্ছে।
যে কোনও ব্যক্তির হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকা জননিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র যত দ্রæত সম্ভব উদ্ধারের পাশাপাশি অস্ত্রধারীকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে সমাজে নিরাপত্তা বলে কিছুই থাকবে না। যার পরিণতি হবে ভয়াবহ। ব্যক্তির হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকা মানেই সেটা যে কোনও মুহূর্তে বেআইনি কিংবা অপরাধমূলক কর্মকান্ডেই ব্যবহার হবে।’