অবৈধ অস্ত্রের মজুদ ‘অক্ষত’

36

 

সিটি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরুর পর গত ১৪ জানুয়ারি রাত আটটার দিকে নগরীর পাঠানটুলী ওয়ার্ডের মগপুকুর পাড় এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের সাথে গণসংযোগকালে পেছন থেকে ছোঁড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন স্থানীয় মহল্লা সর্দার আজগর আলী বাবুল। গুলিবিদ্ধ হন মাহবুব নামে আরও একজন। এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানায় করা হত্যা মামলায় র‌্যাব ও পুলিশ এ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল কাদের ওরফে মাছ কাদেরসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেপ্তার ও আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের হদিস পায়নি। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ নগরীতে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান জোরদার করেছে।
এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও নগরীতে পৃথকভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোঁড়ার অন্তত দুটি ঘটনার ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল নগরীর খুলশী থানার দুই নম্বর গেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক নামধারী বিবদমান স্থানীয় দুটি পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তৈয়ব হোসেন (৩০) ওরফে রুবেল নামে একজন গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করলেও সংঘর্ষে ব্যবহৃত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। তেমনি নগরীর ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর তা বাতিলের দাবিতে বিগত ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পদবঞ্চিতরা কলেজ রোডে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ওই মিছিল থেকে কয়েকজনকে প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ক্লিপে। ফুটেজ দেখে ও পর্যালোচনা করে অস্ত্রধারীদের শনাক্তের পর পুলিশ মো. ইমরান ও সাব্বির সাদিক নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার এবং তাদের কাছ থেকে দু’টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করলেও মাস্টারপুল এলাকার আবু মোরশেদ নামে অপর অস্ত্রধারী অধরাই থেকে যান। তার প্রদর্শিত অস্ত্রেরও সন্ধান মিলেনি। ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে তাকে হাতে থাকা রাইফেল উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়।
এভাবে গত কয়েকবছরে নগরীতে সংঘটিত আধিপত্য বিস্তারে সশস্ত্র মহড়া থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে প্রদর্শিত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের বেশিরভাগই পুলিশের জব্দ তালিকার বাইরেই রয়ে গেছে। এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক মদদপুষ্ট কথিত ‘বড় ভাই’ ও তাদের অনুসারীদের কাছে মজুদ থাকা অবৈধ অস্ত্রেও খুব বেশি টান পড়েনি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্রধারী গ্রেপ্তার হলেও তাদের কথিত বড় ভাই শেষ পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে। তাই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদে তেমন একটা হেরফের হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র মজুদকারীরা রাজনৈতিক দলের অনুসারী কিংবা প্রভাবশালী কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকায় তাদেরকে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে যেমন পুলিশকে বেগ পেতে হয়, তেমনি তাদের অবৈধ অস্ত্রের মজুদেও ‘দ্বিধাহীনভাবে’ হাত দেয়া যায়না। অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন থানা পুলিশ দেশে তৈরি এলজিসহ কয়েকজন অবৈধ অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে।
যে কোনও ব্যক্তির হাতে অবৈধ অস্ত্র থাকা জননিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ হুমকি বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। বিশেষ করে, নির্বাচনের মত অতি স্পর্শকাতর আয়োজনের আগে বৈধ অস্ত্র সাময়িকভাবে থানায় জমা নেয়া এবং যত বেশি সম্ভব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা জরুরি। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রধারীকে আইনের আওতায় আনতে না পারলে তা জনসমাজে যেমন নিরাপত্তা-হুমকি তৈরি করে, তেমনি নির্বাচনেও ভয়ঙ্কর অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। নিকট অতীতে গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে উপ-নির্বাচনের দিন প্রকাশ্যে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের দৃশ্য আমরা দেখেছি। ব্যক্তির হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র থাকা মানেই সেটা যে কোনও মূহুর্তে বেআইনি কিংবা অপরাধমূলক কর্মকান্ডেই ব্যবহার হবে।’
নগর পুলিশের কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর নির্বাচনকে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে এরইমধ্যে তৎপরতা জোরদার করেছে জানিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, একাধিক থানা থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের খবর আমরা পেতে শুরু করেছি। যদিও অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। এই মূহুর্তে নির্বাচনই আমাদের মূল ফোকাস পয়েন্টে রয়েছে। সেহেতু নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তাজনিত যে কোনও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ শান্তি-শৃংখলা বিনষ্ট বা সেরকম কোনওকিছু করার চেষ্টা করলে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছি না। আর বৈধ অস্ত্রের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। এ ব্যাপারে এখনও আমরা কোনও নির্দেশনা পাইনি।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, নগরীতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এলাকাভিত্তিক বড় ভাইদের হাতে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের বিশাল মজুদ। আলোচিত ওয়ান-ইলেভেনে আত্মগোপনে চলে যাওয়া তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অনেকে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় ফিরে এসে ফের আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়। শক্তি বৃদ্ধির জন্য তারা ধীরে ধীরে অবৈধ অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তুলেছে। এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক লেবাসধারী সেসব বড় ভাইরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়েছে নিজ নিজ এলাকার উঠতি বয়সীদের হাতে। বড় ভাইয়ের প্রশ্রয় আর হাতে অস্ত্র পেয়ে কিশোর বয়সেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা। জননিরাপত্তা পড়েছে চরম হুমকিতে। নগরীতে পুরনো সাম্রাজ্যে ফিরে আসা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অনেকে নিজ নিজ ডেরায় অবস্থান নিয়ে এলাকার রাজনৈতিক মদদপুষ্ট বড় ভাইদের সাথে হাত মিলিয়েছে। আর বড় ভাইরা এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার, চাঁদা বা তোলাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে উঠতি বয়সীদের। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া উঠতি বয়সীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দেয়ায় তারা চোখের পলকেই বিপথগামী হচ্ছে। কথায় কথায় কিংবা তুচ্ছ ঘটনায়ও অবৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে উঠতি বয়সীদের। বিদেশি পিস্তল, রিভলবার, এসবিবিএল গানের পাশাপাশি দেশে তৈরি এলজিও তাদের হাতে দেখা মেলে। নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতায়ও কেউ কেউ তাদেরকে ব্যবহার করছে বলে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ উঠেছে।