অবিস্মরণীয় জয় দিয়ে মাশরাফির বিদায়

77

অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি বিন মুর্তজার বিদায়ী ম্যাচে ব্যাটে-বলে জ্বলে উঠলেন তার সতীর্থরা। বইয়ে দিলেন রেকর্ডের বন্যা। দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান লিটন দাস ও তামিম ইকবাল করলেন সেঞ্চুরি। ২৯২ রানের জুটির গড়া পাহাড়সম লক্ষ্য ডিঙ্গাতে ব্যর্থ হওয়া জিম্বাবুয়েকে ডাকওয়ার্থ ও লুইস পদ্ধতিতে ১২৩ রানে হারিয়ে আবারও হোয়াইটওয়াশ করেছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে অধিনায়ক হিসেবে এটি মাশরাফির ৫০তম জয়ও।
গতকাল সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে তৃতীয় ওয়ান ডে-তে কার্টেল ওভারের ম্যাচ, জিম্বাবুয়েকে ৪৩ ওভারে করতে হবে ৩৪২ রান। পাহাড়সম এই লক্ষ্য পার হতে নামা জিম্বাবুয়ের টিনাশে কামুনহুকামউইকে প্রথম ওভারেই ফেরান অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। আউট সুইঙ্গারে ভোগা তিনি লিটন দাসকে সহজে কট বিহাইন্ড ক্যাচ দিয়ে মাঠ ছাড়েন। এর পর রেজিস চাকাভার সঙ্গী হন ব্রেন্ডন টেইলর।
ব্রেন্ডন টেইলর শুরু করলেন তিন চারে। তবে দলীয় ২৮ রানে সাইফ উদ্দিনের লেংথ বল মিড উইকেট দিয়ে খেলতে গিয়ে মোহাম্মদ মিঠুনের হাতে ধরা পড়ে ব্যক্তিগত ১৪ রানে বিদায় নেন তিনি। তৃতীয় উইকেটে চাকাভার সতীর্থ হতে ব্যাট হাতে নামেন শন উইলিয়ামস। দু’জনে ক্রিজে স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্নে বাঁধ সাধেন অভিষেক হওয়া আফিফ। নিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে বেশি কিছু করতে না পারলেও বল হাতে সামর্থ্য দেখালেন। দলীয় ৭৪ রানে দ্বিতীয় বলেই শন উইলিয়ামসকে বোল্ড করে ভাঙলেন ৪৬ রানের জুটি। বিদায় নেয়ার আগে উইলিয়ামস করেন ব্যক্তিগত ৩০ রান। চতুর্থ উইকেট জুটিতে ওয়েসলি মাধেভেরেকে পেলেন রেজিস চাকাভা। নেমেই শক্ত জুটি তৈরিতে ব্যস্ত দুই অভিজ্ঞ। দলীয় ইনিংস নিয়ে যান ১১৩ রানে। ২২তম ওভারের প্রথম বলেই দারুণ এক ডেলিভারিতে এক প্রান্ত আগলে রাখা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান রেজিস চাকাভাকে বোল্ড করে দিলেন বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল। মূলত ১১৩ রানে প্রথম সারির চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে মাটিতেই গড়াগড়ি খাচ্ছিল সফরকারিরা। চাকাভাকে সাজঘরের পথ দেখালেও পাঁচ নাম্বারে নামা ওয়েসলে মাধভেরে দ্রূতগতিতে রান তোলার চেষ্টা চালিয়ে একটু ভয় ছড়াতে চেয়েছিলেন স্বাগতিকদের। কিন্তু অর্ধশতক রানের দিকে যাওয়া এই জিম্বাবুয়ানকে ২৭তম ওভারের চতুর্থ বলে দলীয় ১৫০ ও ব্যক্তিগত ৪২ রানের মাথায় নিজের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত করেন সাইফউদ্দিন। অধিনায়ক সিকান্দার রাজা এক প্রান্ত আগলে রেখে শুধু পরাজয়ের ব্যবধান কমানোর চেষ্টায় থাকলেও তার সতীর্থদের দাঁড়াতেই দেয়নি মুস্তাফিজ-মেহিদী-সাইফউদ্দিনরা। ২৮তম ওভারে মিরাজের কাছ থেকে প্রথম চার বলে সিকান্দার রাজা তুলে নেন ১৪ রান। পঞ্চম বলে রিচমন্ত মুতুমবামিকে শূন্যরানে রানআউটের ফাঁদে ফেলেন তামিম ও মিরাজ। জিম্বাবুয়ের বিপদ আরও বাড়ে টিনোটেন্ডা মুতোমবোজির (৭) বিদায়ে। তাকে আউট করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের ম্যাচে তিরিপানো ঝড় তুলেছিলেন। এই ম্যাচেও হয়তো আশঙ্কা ছিল এমন কিছুর। হয়নি শেষ পর্যন্ত। তাকে ১৫ রানেই বোল্ড করেছেন তাইজুল ইসলাম। তবে এক প্রান্ত আগলে সিকান্দার রাজা লড়াই চালিয়েছেন দৃষ্টিনন্দন কিছু শটস খেলে। ৫০ বলে ৬১ রান করে ফেলা সিকান্দার রাজাকে বিদায় দিয়েছেন সাইফউদ্দিন। উড়িয়ে মারলেও তাকে বাউন্ডারিতে তালুবন্দী করেন মোহাম্মদ নাঈম। এই সাইফ পরের বলে তিশুমাকে বোল্ড করেই ছেটে দেন জিম্বাবুয়ের লেজ। তারা ৩৭.৩ ওভারে গুটিয়ে যায় ২১৮ রানে। ৪১ রানে ৪ উইকেট নিয়েছেন সাইফ। দুটি নিয়েছেন তাইজুল, একটি করে নিয়েছেন মাশরাফি, মোস্তাফিজুর ও আফিফ।
এর আগে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে দুর্দান্ত সূচনা করেন বাংলাদেশ দলের দুই ওপেনার তামিম ইকবাল এবং লিটন দাস। দু’জনই আগের দুই ম্যাচে খেলেছেন দুর্দান্ত দুটি সেঞ্চুরির ইনিংস। প্রথম ম্যাচে লিটন অপরাজিত ১২৬ এবং দ্বিতীয় ম্যাচে তামিম খেলেন ১৫৮ রানের ইনিংস।
এমন দুই ব্যাটসম্যান যদি একইসঙ্গে জ্বলে ওঠেন? প্রতিপক্ষের তবে বারোটা বাজারই কথা, যেটা টের পেল জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশের দুই ওপেনারই একসঙ্গে জ্বলে ওঠেন।
দেখেশুনে শুরু করার পর মাত্র ৫২ বলে ৫০ রানের জুটি গড়ে ফেলেন তামিম-লিটন। এরপর ১১০ বলে ছুঁয়ে ফেলেন ১০০ রানের জুটি। পরের ৫০ পার করতে একটু সময় নিয়েছেন তারা। ১৭৮ বলে দেড়শ ছোঁয়া হয় এই জুটির। তারা ১৮২ রানে পৌঁছার পর ঝমঝমিয়ে নামে বৃষ্টি। তখন ৩৩.২ ওভার খেলা হয়েছে।
আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় খেলা বন্ধ থাকে বৃষ্টিতে। দ্বিতীয়বার যখন শুরু হয়, তখন ওভার কমিয়ে ৪৩ করা হয়। বাংলাদেশ পায় আর ১০ ওভারের (৯.৪ ওভার) মতো ব্যাটিংয়ের সুযোগ।
ওভার কমে যাওয়ায় রীতিমত মারমুখী হয়ে ওঠেন তামিম-লিটন। চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে থাকেন মাঠ জুড়ে। এরই ফাঁকে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটির রেকর্ডটিও নিজেদের করে নেন এই যুগল।
২০১৭ সালে কার্ডিফে সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মিলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম উইকেটে ২২৪ রানের জুটি গড়েছিলেন। সেটি ছিল এতদিন ওয়ানডে ক্রিকেটে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি।
লিটনের পর সেঞ্চুরি তুলে নেন তামিমও। ৯৮ বলে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করেন দেশসেরা ওপেনার। দুই সেঞ্চুরিয়ান তারপরও বেধড়ক পেটাতে থাকেন জিম্বাবুইয়ান বোলারদের। একটু বেশিই বিধ্বংসী ছিলেন লিটন। ১৩৫ বলে ১৫০ রান স্পর্শ করেন মারকুটে এই ব্যাটসম্যান।
যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, লিটন দুইশও কি গতকাল করে ফেলেন কি না- ভাবছিলেন টাইগার সমর্থকরা। শেষতক লিটনের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটা থেমেছে ১৭৬ রানে। ১৪৩ বলের বিধ্বংসী ইনিংসে ১৬টি চারের সঙ্গে ৮টি ছক্কা হাঁকান এই ডানহাতি, গড়েন দেশের ইতিহাসের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ডও।
এরপর মাহমুদউল্লাহ (৩) সুবিধা করতে পারেননি। মাম্বার বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান। ৩ বলে ৭ রানে ফিরে যান আফিফ হোসেন ধ্রূবও। তবে তামিম শেষ পর্যন্ত অপরাজিতই ছিলেন। ১০৯ বলে ৭ চার আর ৬ ছক্কায় দেশসেরা এই ওপেনার খেলেন ১২৮ রানের ইনিংস। এটি তার টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি।