অবিরল অশ্রুঝরা দিন

48

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে পালন করছে দিনটি।
১৯৭৫ সালের শোকাবহ এই কালোদিবসে ভোর রাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপদগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃস্বত্ত¡া স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীতে মহান আল্লাহর দরবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। খবর বাসস’র
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এ মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এ উপলক্ষে তথ্য ভবনে পক্ষকালব্যাপী এক আলোক চিত্র প্রদর্শনী চলছে। এবারো সরকারি ভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটির বিভিন্ন কর্মসূচি। সরকারি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- ১৫ আগস্ট সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি ভবনসহ বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা এবং আলোচনা সভা। এদিন সরকারি ছুটি থাকবে।
ভোরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পুুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করবেন এবং সশস্ত্র বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করবে। এছাড়া ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পরে সকাল সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী বনানী কবরস্থানে জাতির পিতার পরিবারের শাহাদাত বরণকারী সদস্য ও অন্য শহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ এবং দোয়া করবেন।
আজ সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়া সেখানে ফাতেহা পাঠ, সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান এবং মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি সমাধিস্থলে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারাদেশে মসজিদসমূহে বাদ জোহর বিশেষ মোনাজাত এবং মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীতে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার মুদ্রণ ও বিতরণ এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গ্রোথ সেন্টারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জাতীয় শোক দিবসের পোস্টার স্থাপিত হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবসে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
জাতীয় কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে তারা কর্মসূচি পালন করবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিস্থলে এবং ঢাকায় ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা করবে।
দেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য জাতীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্ব স্ব কর্মসূচি পালন করবে।
আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৫ আগস্ট সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। সকাল ৭টা ৩০মিনিটে বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল। সকাল ১০টায় টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। এতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষে জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
দিনের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং সুবিধামতো সময়ে মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা। দুপুরেÑ অস্বচ্ছল, এতিম ও দুঃস্থ মানুষদের মাঝে খাদ্য বিতরণ। বাদ আছর বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে । শোক দিবসের দ্বিতীয় দিন বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম নগর উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু করে। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারি ইতিহাস রচিত হতে থাকে । সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোন জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ বলা হয় ‘সবকিছু সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোস্তাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনীদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়।
একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এএফএম মোহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকান্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন। ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনীদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামীর উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় প্রদান করে। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদন্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামীর ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ এক বিবৃতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী, জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে দেশবাসীকে সাথে নিয়ে পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতির বাণী : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আত্মনিয়োগ করতে সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূসহ নিকট আত্মীয়গণ শাহাদাত বরণ করেন। আমি শোকাহত চিত্তে তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’
তিনি বলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এক কলঙ্কিত অধ্যায়। দেশের স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ঘাতকচক্র বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা শহিদ হন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। ফাঁসির মঞ্চেও তিনি বাংলা ও বাঙালির জয়গান গেয়েছেন। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, যা ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তাঁরই নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হবে। এ দুটি জাতীয় অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে উদযাপনের জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে তাঁর ত্যাগ এবং তিতিক্ষার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ ধারণ করে সবাই মিলে একটি অসা¤প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহŸান জানিয়েছেন।
তিনি জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আজ দেয়া এক বাণীতে এ আহবান জানিয়ে আরো বলেন, ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসুন, আমরা জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করি। তাঁর ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনাদর্শ ধারণ করে সবাই মিলে একটি অসা¤প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। প্রতিষ্ঠা করি জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।”
প্রধানমন্ত্রী মহান আল্লাহ্তায়ালার দরবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগস্টের সকল শহিদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বলেন, জাতির পিতার দূরদর্শী, সাহসী এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। বাঙালি পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু যখন সমগ্র জাতিকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত, তখনই স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী চক্র তাঁকে হত্যা করে। এই হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অগ্রযাত্রাকে স্তব্দ করার অপপ্রয়াস চালায়।
ঘাতকদের উদ্দেশ্যই ছিল অসা¤প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোকে ভেঙে আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই জঘন্য হত্যাকাÐের সঙ্গে জড়িত স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকেই হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করে। তারা ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথও বন্ধ করে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করে। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করে। বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দেয়। স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব দেয়। রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করে। পরবর্তী বিএনপি-জামাত সরকারও একই পথ অনুসরণ করে।

বঙ্গবন্ধুর চার খুনি কোথায় জানা নেই

জাতির পিতার খুনিদের মধ্যে পলাতক ছয়জনকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উদ্যোগের কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও তাদের কে কোন দেশে পালিয়ে রয়েছেন, সবার সেই তথ্য এখনও জোগাড় করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
এই ছয়জন হলেন খন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান।
পলাতক এই ছয়জনের বিষয়ে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিস জারি করা আছে। ২০০৯ সালে এই নোটিস জারির পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হচ্ছে।
এই ছয়জনের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)’র সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা মহিউল আলম।
তিনি বুধবার জিজ্ঞাসায় বলেন, নূর চৌধুরীর কানাডায় এবং রাশেদ চৌধুরীর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের অবস্থান কোথায়, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
নূর চৌধুরী কানাডায় থাকলেও ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখিয়ে আসছে দেশটির সরকার; যদিও তাকে ফেরত পেতে বারবার দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
রাশেদ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ তাকে ফেরত চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র তা এড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।
স¤প্রতি থাইল্যান্ডে এক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে বলেন রাশেদ চৌধুরীর বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করতে।
মোমেনের ভাষ্য অনুযায়ী, তখন পম্পেও উল্টো জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ কাকে চায় রাশেদ চৌধুরী না কি ডেভিড ওয়াটসনকে। অর্থাৎ রাশেদ চৌধুরী নাম পাল্টেও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে থাকতে পারেন।
মাজেদ ও মোসলেম উদ্দিনের ব্যাপারে এনসিবি’র কর্মকর্তা মহিউল জানান, সর্বশেষ এই দুজনের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানে বলে শোনা যাচ্ছিল। তখন দুই দেশকে চিঠিও দেওয়া হয়।
‘ভারত জবাবে বলেছে, তাদের দেশে নেই। পাকিস্তান কোনো জবাব না দেওয়ায় রিমাইন্ডার দেওয়ার পরও কোনো উত্তর মেলেনি। ফলে তাদের অবস্থান এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।’
রশিদ ও ডালিমের অবস্থানের বিষয়েও স্পষষ্ট তথ্য নেই।
মহিউল বলেন, ‘রশিদের ব্যাপারে সম্ভাব্য যে সব দেশের নাম শোনা যাচ্ছে, তা হচ্ছে ফ্রান্স, ইতালি, লিবিয়া, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। আর ডালিম চীন, ইংল্যান্ড, হংকং, কেনিয়া, লিবিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে কোনো এক দেশে আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে।’
প্রতিটি দেশে চিঠি পাঠিয়ে সহযোগিতা চাওয়া হলেও তার কোনো জবাব এখনও মেলেনি বলে জানান এই কর্মকর্তা। খবর বিডিনিউজের

শোকর‌্যালিসহ নানা আয়োজন চট্টগ্রামে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৪তম শাহাদত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে নগর ও জেলায় নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগের আয়োজনে নন্দনকাননের ডিসি হিল সংলগ্ন এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের সামনে থেকে এ শোকযাত্রা বের হবে। এতে নেতৃত্ব দেবেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। খবর বাংলানিউজের
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশে বিশ্বাসী মানুষকে শোকযাত্রায় যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নাগরিক উদ্যোগের আহŸায়ক ও বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী
সকাল সাড়ে ৮টায় নগরীর আন্দরকিল্লার করপোরেশন কার্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও কালো ব্যাজ ধারণ এবং সকাল ৯টায় খতমে কোরআন, মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভা কেবি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে।
দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল সাড়ে ১০টায় দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় সভা। দুপুর ১২টায় এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে শোকসভা।
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সকালে জাতীয় পতাকা ও কালো পতাকা উত্তোলন, বেলা ১১টায় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। দুপুরে ক্লাবের পিএইচপি ভিআইপি লাউঞ্জে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এসব কর্মসূচিতে অংশ নিতে উভয় সংগঠনের সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন ক্লাবের সভাপতি আলী আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ এবং ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাইনুদ্দিন দুলাল ও সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস।
এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে খতমে কোরআন, দোয়া মাহফিল, মেজবান, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।