অবশেষে স্বস্তির বৃষ্টি

158

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কালবৈশাখীর তান্ডব জানমাল কেড়ে নিলেও চট্টগ্রামের প্রকৃতি ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র বিদায়ের পর থেকে কার্যত তেঁতেই আছে। বিরাজমান আবহাওয়া পরিস্থিতিতে গিরিকুন্তলা ও সাগরদূহিতা চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাপমাত্রার পারদ সংখ্যাগত দিক থেকে তাপদাহের ঘর না ছুঁলেও বাতাসে জলীয় বাষ্পের স্বল্পতাজনিত কারণে গরম অনুভূত হচ্ছে মাঝারি মাত্রার তাপদাহের মতোই! গতকাল শুক্রবার দিনে জেলার উপকূলীয় জনপদ সীতাকুন্ড ও সন্দ্বীপে মৌসুমের ‘মুখ রক্ষার’ ছিটেফোঁটা বৃষ্টিপাত হয়েছে। অধিদপ্তরের রেকর্ড করা পরিসংখ্যানে যা ছয় এবং তিন মিলিমিটার। অবশ্য রাতে নগরেও বজ্র-মেঘের ডঙ্কার সাথে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল। আজ শনিবার দিনের শুরুতেও একই ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা তাতে গরমে স্বস্তির ভাব খুব বেশি নাও মিলতে পারে বলে মনে করছেন।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন ওয়েবসাইটের পূর্বাভাস বলছে, চলতি মে মাসের শেষ সপ্তাহজুড়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বজ্র-ঝড়ের ঘনঘটা রয়েছে। যা শুরু হতে পারে আগামী ২৪ মে বা তার পরদিন থেকে। অব্যাহত থাকবে মাসের একেবারে শেষ পর্যন্ত। তখন বাতাসে আদ্রতার পরিমাণও তুলনামূলকভাবে খানিকটা কমে আসবে। আশির ঘর থেকে নেমে বাতাসে আদ্রতার হার সত্তর থেকে ৭৫ শতাংশে উঠানামা করতে পারে। অস্বস্তির গরম থেকে মুক্তি মিলবে কার্যত মাসের শেষ সপ্তাহেই। এই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টির আলামতও দেখছেন আবহাওয়াবিদরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের বৈশাখ শুরু থেকেই তাপদাহে তার ঝাঁঝ বুঝিয়ে দিচ্ছে। অস্বস্তির গরমে কাবু প্রাণিকূল। অসহনীয় তাপ আগুনের হল্কা হয়েই যেন বিধছে শরীরে। বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকায় গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র বিদায়ের পর বাতাসে আদ্রতার উপস্থিতি বেশি থাকায় সারা দেশেই অনুভূত হচ্ছে অস্বস্তির গরম। ঘরে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসও খুব বেশি শীতল পরিবেশ এনে দিতে পারছে না। দিনভর প্রখর সূর্যের কিরণের সাথে আসা অতিবেগুনী রশ্মি ঘরের দেয়াল আর ছাদেও যেন উষ্ণতা জমিয়ে দিচ্ছে। সূর্য ডোবার পর দেয়াল ও ছাদে জমা উষ্ণতা বাতাসে মিশছে। সামর্থ্যবানদের ঘরে ও কর্মস্থলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু থাকছে হরদম। নিম্নবিত্তদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল শুক্রবার যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। এছাড়া, সর্বোচ্চ ৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে রংপুর অঞ্চলের রাজারহাটে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ দশমিক৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করেছে। এর মধ্যে নগরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ আশরাফুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুমে অঞ্চলভেদে মৃদু বা মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে, এবার তাপদাহ ছাড়াও কোনও কোনও অঞ্চলে গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। অসহনীয় গরম অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এটা বাতাসে জলীয় বাষ্পের স্বল্পতার কারণে। মাসের শেষে ঝড়-বাদলে গরমের তীব্রতা কমে আসবে।’
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানতঃ শুষ্ক থাকতে পারে। টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলসহ খুলনা বিভাগের উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে তা কিছু কিছু জায়গায় অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, বাংলাদেশের উষ্ণতম মাস হল এপ্রিল-মে। বাংলা বর্ষপঞ্জির ঋতু পরিক্রমায় গ্রীষ্মের হামাগুড়ির সময়। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম পক্ষের বিদায়ে যাত্রা শুরু হয় মে মাসের। ২০১৭ সালের মে মাসে টানা ১৯ দিনের তাপদাহে বিপর্যস্ত হয়েছিল সারাদেশ। ওইবছর ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলায় দিনের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁইছুঁই। রাজশাহীতে তাপমাত্রার পারদ মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে ছিল। কিন্তু, গত বছর মানে ২০১৮ সালের মে মাস ছিল উল্টো বৃষ্টিমুখর। ওই বছর মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে দেশে গড় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অধিদপ্তরের গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা ৩০ বছর গ্রীষ্ম ঋতুতে গড় বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কিছু কম। কিন্তু জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সাল থেকে গ্রীষ্ম ঋতুতে আবহাওয়া পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ওই বছর থেকে গ্রীষ্ম ঋতুতে অতিবৃষ্টি, দীর্ঘ সময় ধরে কালবৈশাখী, অত্যধিক বজ্রপাতের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এর আগে অধিদপ্তরের মে মাসের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, পুরো মে মাসজুড়েই দেশের অধিকাংশ এলাকায় কমবেশি দাপট থাকবে তাপদাহের। আবার সাগরও কমবেশি উত্তাল থাকতে পারে। মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য স্থানে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টির আলামত রয়েছে, যার একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। উল্লেখ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।