অবশেষে সিটি কর্পোরেশনের অধীনেই যাচ্ছে ফ্লাইওভার

68

নগরীতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারসহ চারটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করে। বিগত সময়ে সিডিএ যেসব উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পন্ন করে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ফ্লাইওভার নিয়ে বিগড়ে বসে সংস্থাটি। কখনও ফ্লাইওভারের নিচে দোকান আবার কখনও টোল আদায়ের উদ্যোগ নেয়। কারণ হিসেবে দেখায়, ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণ করার মত নিজস্ব কোনো ফান্ড নেই সিডিএ’র। তবে তীব্র সমালোচনার মুখে এমন অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় উন্নয়ন সংস্থাটি। পরে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারটি সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পথ সুগম হচ্ছে। একইসাথে অপর তিনটি ফ্লাইওভারও হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৮-এর ২৬ ধারা অনুযায়ী মহাপরিকল্পনা বা মধ্য বা স্বল্প মেয়াদি কোনো প্রকল্পের কাজ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পন্নের পর বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, উক্ত প্রকল্পের অধীনে সমাপ্ত অবকাঠামো যেমন- উদ্যান, রাস্তা, নদর্মা এবং অনুরূপ অন্যান্য সেবা ও সুবিধাসমূহ স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার নিকট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ন্যস্ত করা যাবে।
অন্যদিকে, ২০০৯ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের সিটি কর্পোরেশন সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও অধ্যাদেশসমূহ একীভূত, অভিন্ন এবং সমন্বিতকরণকল্পে প্রণীত আইনের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, কর্পোরেশন নগরীর অধিবাসী এবং নগরীতে আগন্তুকদের আরাম ও সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা এবং অন্যান্য ব্যবস্থাও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। ফ্লাইওভারও এক ধরনের রাস্তা, তাই সিটি কর্পোরেশন প্রথম থেকে এই সড়ক হস্তান্তর করার জন্য আহবান জানিয়ে আসছিল।
এদিকে নির্মাণের পর সিডিএ ফ্লাইওভারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণসহ সার্বিক দেখভালের দায়িত্বও পালন করছে না। এতে করে ফ্লাইওভারগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্লাইওভারে বসানো বাতির অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এতে অন্ধকারচ্ছন্ন ফ্লাইওভারে রাতে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এছাড়াও ফ্লাইওভারগুলোর রেলিংয়ের অনেক অংশে স্টিল ও লোহার পাইপসহ লৌহজাত সামগ্রী চুরি হয়েছে।
এছাড়া রাতের বেলায় ফ্লাইওভার দিয়ে জনসাধারণের চলাচলে নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রতিটি ফ্লাইওভারের ওপর বালি-ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প জমে আছে। এর ফলে বৃষ্টিতে ফ্লাইওভারের পানি নির্গমনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নিচের সড়কের মতো ফ্লাইওভারের ওপরও পানি জমে যায়। একইভাবে ফ্লাইওভারসম‚হ নির্মাণের সময় ওপর থেকে নিচে পানি প্রবাহের যে নালা তৈরি করা হয়েছিল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলোও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ফলে ফ্লাইওভারের ওপরে এবং নিচে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ছাড়া বাকি তিনটি ফ্লাইওভারের নিচের অংশে করা ফুলের বাগানসমূহ বর্তমানে ময়লা-আবর্জনা এবং বখাটেদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।
নগরীর মূল সড়কের ওপর নির্মিত ফ্লাইওভারগুলো নিয়ে প্রথম থেকেই নগর পরিকল্পনাবিদদের একটি বিরাট অংশের আপত্তি ছিল। এরপরও বিপুল অর্থ ব্যয়ে সিডিএ কর্তৃক ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণের পর একাধিকবার ব্যবহার সীমিত পর্যায়ে দেখা যায়। তাছাড়া ফ্লাইওভারগুলো নির্মাণের সময় এবং পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সঠিক পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় এ সব দুর্ঘটনা ঘটে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন। এছাড়াও ড্রেনেজ সিস্টেমে ত্রæটির কারণে নগরে জলাবদ্ধতায় জনগণের ভোগান্তি বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
জানা যায়, রক্ষাবেক্ষণের জন্য ফ্লাইওভারের নিচে ১৪টি দোকান ও তিনটি সুপারশপ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। পরে জাস্টিস ফাউন্ডেশন নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের করা রিটে ফ্লাইওভারের নিচে সড়ক বিভাজকের ওপর দোকান নির্মাণের ওপর ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে ব্যর্থ হয়ে ফ্লাইওভার ব্যবহারকারী গাড়ি থেকে টোল আদায় করে খরচ মেটাতে চায় সিডিএ। তৎকালীন চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতামত চায়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন টোল ছাড়াই ফ্লাইওভারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণে নিজেদের মতামত প্রদান করে। ঐ মতামত পাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত ১৪ জুলাই গণপ‚র্ত মন্ত্রণালয়কে ফ্লাইওভারসমূহ সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানায়।
এদিকে সিডিএর পক্ষ থেকেও ফ্লাইওভারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিটি কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তরের ব্যাপারে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে পত্র দেয়া হয়েছে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, ফ্লাইওভারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বহুল। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে পত্র দেয়া হয়েছে। মতামত পাওয়ার পর ফ্লাইওভারগুলো সিটি কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হবে।
সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পূর্বদেশকে বলেন, কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়া টোল আদায় ও দোকান নির্মাণ করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে চেয়েছিল সিডিএ। জনরোষে ও মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে তাদের এমন উদ্যোগ থেকে সরে আসতে হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, আমরা টোল আদায় ছাড়া ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের কথা জানিয়েছি। আশা করছি এভাবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
মন্ত্রণালয় চাইলে ফ্লাইওভার হস্তান্তর করতে কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন সিডিএ’র চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিদ্যমান আইন নিয়ে আমাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে, আমরা উত্তর দিয়েছি।