অফুরন্ত বরকতের মাস পবিত্র রমজানুল করিম

125

মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে অশেষ শুকরিয়া, তিনি আমাদেরকে আবারো সুস্থ শরীরে মাহে রমজানের মত বরকতময় মাস নসীব করেছেন, আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। সে সাথে হাজারো দরুদ ও সালাম পেশ করছি দো জাহানের সর্দার প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.) এর ওপর, যিনি না হলে আমরা এ মহান, বরকতময় মাস পেতাম না। মহান আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক মাসকে শুভেচ্ছা স্বাগতম জানিয়ে যে নূরাণী ভাষণ দিয়েছেন তা সকল ঈমানদার মুসলমান উম্মতির মুহাম্মদীর জন্য উভয় জাহানে জান্নাতি খোশ খবর চির শান্তিময় এক মহান নেয়ামত।
মাহে রমজান এমন একটি মাস, যার ফযিলত অগুণিত। রমজানই একমাত্র মাস, যে মাসে প্রতিটি ভালো কাজের সওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়, নফলের সওয়াব হয়ে যায় ফরজের সমান। রোজা শুধু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজের সঙ্গে রোজার সম্পর্ক ঘোষণা করেছেন। তিনি সব ইবাদত-বন্দেগি থেকে রোজাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছেন।
২য় হিজরীর শাবান মাসে মদীনায় রোজা ফরজ সংক্রান্ত আয়াত নাজিল হয় ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা সংযমী হও। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩)। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা আরও বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সেই মাসকে পায় সে যেন রোজা রাখে’। প্রিয় নবীজি (সা.) এর প্রিয় সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)। হযরত শাহ্ ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম (সা.) এরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)। যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পরিতৃপ্তির সঙ্গে সেহেরী, ইফতার করাবেন যদিও এক গøাস পানি বা একটি খেজুর দ্বারা হলেও ইফতার করায় তাহলে মহান দয়াময় আল্লাহতালা তাকে আমার হাউজ কাউছার হতে যে মিষ্টি মধুর শীতল পানীয় পান করাবেন যা অন্য কোন পানীয় তার তুলনা হয় না। ফলে জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না। এটা এমন একটি মাস প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফেরাত অর্থাৎ ক্ষমা চাওয়া আর শেষ দশক অংশ হল নাজাত অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মাস। বিশেষ করে শেষ দশকে ২৬শে দিনগত ২৭শে রমজানের রাত্রে বান্দা লাইলাতুল কদরের মতো মহামাম্বিত বুর্জুগীরাত আনুষ্ঠিকভাবে পালন করলেও কিন্তু মহান আল্লাহ পাক বান্দার আমল বৃদ্ধি করার জন্য এ রাতকে গোপন রেখেছেন। যেমন- শবে মেরাজ, শবে বরাত দুই ঈদের দুই রাত, বছরের পাঁচটি বুজুর্গ রাত নির্দিষ্ট তারিখে হলেও এ রাতকে গোপন করার উদ্দেশ্য বান্দার আমল উন্নত করার জন্য এজন্য প্রত্যেক রোজাদারের উচিত শেষ দশকে প্রতিটি বেজোড় রাত্রে একুশে রাত, তেইশে রাত, পচিঁশে রাত, সাতাইশে রাতসহ ঊনত্রিশে রাত পর্যন্ত শবে কদর তালাশ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাহলে যে কোন একটি রাত্রে তার ভাগ্যে শবে কদর মিলবে। এছাড়া তাওবা কারীর জন্য পবিত্র এ মাহে রমজানুল মোবারক মাসে হচ্ছে গুনাহগারদের জন্য গুনাহাতা মারজানা হওয়ার বড়ই মোক্ষম মাস। বিশেষ করে রমজানের শেষ রাত্রে যখন তাহাজ্জুদের সময় তখন মহান আল্লাহতায়লার রহমতের ধরিয়া উত্তাল হতে থাকে (সহী ইবনে হুজাইমা গ্রন্থে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে।)
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, হুজুর (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও ছাওয়াবের নিয়তে রমযান মাসের রাতে এবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারী, মুসলিম)
আমরা জানি মাহে রমজান অফুরন্ত ফজিলতের মাস। রমজান মাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ তারাবি, তাহাজ্জুদ, সুন্নত ও নফল নামাজ আদায়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। রমজান মাসের জুমাবার; মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ইসলামের দৃষ্টিতে দিনটি অনেক বরকতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ এ দিনকে অন্যান্য দিনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা এই দিনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর ইবাদতের জন্য দ্রæত যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ।’ সূরা জুমুআ :০৯।
হাদিসে জুমাবার তথা শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলছেন, হে মুসলমানগণ! জুমআর দিনকে আল্লাহ ্ তাআলা তোমাদের জন্য (সাপ্তাহিক) ঈদের দিন হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। তোমরা এদিন মিসওয়াক কর, গোসল কর ও সুগন্ধি লাগাও।’ (মুয়াত্তা, ইবনু মাজাহ, মিশকাত)। এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করে ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, শুক্রবার এবং এই দিনের ইবাদত-বন্দেগি, জুমার নামাজ ইত্যাদির গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে আজকের শুক্রবার রমজান মাসে হওয়ায় এর তাৎপর্য আরও বহুগুণ বেশি। জুমার দিন মসজিদে উত্তম পোশাক পরিধান করে যেতে বলা হয়েছে। সে সঙ্গে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে পরে এসে মুসল্লিদের ঠেলে কাতারের সামনের দিকে যেতে। এমনকি, কাউকে তুলে দিয়ে সেখানে বসতেও নিষেধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জুমার নামাজে তিন ধরনের লোক হাজির হয়। ক. এক ধরনের লোক আছে, যারা আল্লাহর মসজিদে প্রবেশের পর তামাশা করে, তারা বিনিময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তামাশা ছাড়া কিছুই পাবে না; খ. দ্বিতীয় আরেক ধরনের লোক আছে, যারা জুমায় হাজির হয় সেখানে কিছু দোয়া-মোনাজাত করে, ফলে আল্লাহ যাকে চান, তাকে কিছু দেন আর যাকে ইচ্ছা দেন না এবং গ. তৃতীয় প্রকার লোক হলো যারা জুমায় হাজির হয়, চুপচাপ থাকে, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনে, কারও ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে এগোয় না, কাউকে কষ্ট দেয় না, তাদের দুই জুমার মধ্যবর্তী সাত দিনসহ আরও তিন দিন যোগ করে মোট ১০ দিনের গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন।’ আবু দাউদ শরিফ।
শুক্রবারে বিশেষ করণীয় হলো সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করা। এই সূরা তিলাওয়াতের ফজিলত অনেক বেশি। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যারা জুমার দিন সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করবে, আল্লাহ তাদের জন্য একটা নূর সৃষ্টি করবেন, যা কিয়ামতের দিন তাদের জন্য আলোর কারণ হবে।’ তিরমিজি শরীফে বর্ণিত হয়েছে, জুমআর রাতে বা দিনে যে ব্যক্তি ঈমান নিয়ে মারা যায়; আল্লাহ তায়ালা তাকে কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেন।’
জুমার নামাজে মুসল্লিরা যাবতীয় কাজকর্ম স্থগিত রেখে মসজিদ অভিমুখে গমন করেন এবং সবাই একত্রে জামাতে নামাজ আদায় করেন। এভাবে মসজিদে নামাজ পড়তে এলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। গড়ে ওঠে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, পারস্পরিক হৃদ্যতা ও স¤প্রীতি। আর মানুষের প্রতি রোজার বিধান প্রদানের উদ্দেশ্যই হলো, মানুষের মধ্যে উল্লিখিত গুণগুলো সৃষ্টি করা।
পবিত্র মাহে রমজানুল মোবারক মাসে চারটি আমল বেশি বেশি করবেন তার মধ্যে দুইটি আমল হল যে মহান আল্লাহ তাআলা খুশি হন। সে দুইটি হল ১) লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পড়া এবং আল্লাহর কাছে ইজতেগফার করা অর্থাৎ ক্ষমা চাওয়া আর দুইটি আমল এমন যে যাহা আমাদের না করে কোন উপায় নাই। আর সেই দুটি আমল হল মহান আল্লাহতাআলা কাছে জান্নাত চাওয়া আরেকটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া, এ চারটি আমল তো আমরা সারা বছরের চাওয়া আবশ্যক। তবে পবিত্র রমজান মাসে চাওয়া আরো বেশি বেশি গুরুত্বপুর্ণ। এ মাসের আমাদের অধীনে সরকারি, বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে যেমন-শিল্প কারখানা, অফিস আদালত, দোকান, দপ্তর এবং বাড়ী ঘরের কর্ম অধীনস্থদের কর্মবার হালকা করে দিয়ে এ মহান রমজানুল মোবারক মাসে আল্লাহর তাআলার সন্তুষ্টির জন্য যে মালিকগণ সুযোগ করে দেবেন, মহান আল্লাহ রাসূলপাক (স.) এরশাদ করেছেন- মহান আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাতবাসী করে দেবেন। আমাদের সকলের কর্তব্য মহান আল্লাহের অনুগ্রহের যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করা এ মাসের ফজলিত ও তাৎপর্য অনুবাধনের সচেষ্ট হওয়া এবং এবাদত বন্দেগীসহ সব কাজে নিয়োজিত থাকা। সহী নিয়তে রোজা পালনের সঙ্গে সব সময় দোয়া, তাজবীহ্, পবিত্র কোরআন তেলোয়াত করা সহ ইবাদত বন্দেগী করার মাধ্যমে পবিত্র রমজানুল মোবারক মাসে যথাযথ গুরুত্বসহকারে আমল করে মহান আল্লাহু তালার সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুক। আমীন।
লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক