অপ্রতিদ্বন্দ্বীকথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

206

১৫ সেপ্টেম্বর কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের ১৪৩ তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে-
বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্ব›দ্বী কথা শিল্পী, মানবদরদী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৮৭৬ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার মান মতিলাল চট্টোপাধ্যায় (১৮৫৬-১৯০২ খ্রি:) এবং মাতার নাম ভ‚বন মোহিনী দেবী (১৮৬৩-১৮৯৫ খ্রি:) বাল্য ও কৈশর সময় টুকু তার মাতুলালয়, ভগলপুরে কাটে। শরৎ চন্দ্রের ডাক নাম ছিল ন্যাড়া। আর্র্থিক সংকটের কারণে এফ, এ শ্রেণিতে (বর্তমান আই, এ) পড়ার সময় তাঁর ছাত্র জীবনের অবসান ঘটে। এরপর ১৮৯৩ সালে তিনি ভাগলপুর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ১৮৯৩ সালে তিনি তেজ নারায়ন জুবিলী কলেজিয়েট স্কুলে ফার্স্ট ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উর্ত্তীণ হন এবং ঐ বছরেই তেজনারায়ন জুবিলী কলেজে এফ, এ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৫ সালে নভেম্বর মাসে শরৎ চন্দ্রের “মা” ভূবন মোহিনী দেবী মৃত্যু মুখে পতিত হন। মায়ের মৃত্যুর পরে অর্থাভাবে তাঁর পড়াশুনার অচীরেই বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০২ সালে তার বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ভগলপুরে মৃত্যুবরণ করেন। সন্ন্যাসি বেশে কিছুদিন ইতস্তত: ঘোরাফেরা করার পর অবশেষে ১৯০৩ সালে এপ্রিল মাসে ভাগ্যের খোঁজে মায়ানমারের রেঙ্গুনে একাউন্টটেন্ট জেনারেল অফিসে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে কেরাণী পদে চাকরী গ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাসে শরৎ চন্দ্র শান্তি দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯০৭ সালে শান্তি দেবীর গর্ভে তার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহন করে। এই ১৯০৭ সালে সরলা দেবী সম্পাদিত বিখ্যাত “ভারতী” পত্রিকায় তার প্রথম উপন্যাস “বড় দিদি” প্রকাশিত হয় এবং তিনি বাংলা সাহিত্যে রাতারাতি খ্যাতির শিখরে আরোহন করেন। ১৯০৮ সালে তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ভয়ঙ্কর প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তার স্ত্রী শান্তি দেবী এবং একমাত্র পুত্র সন্তান (১ বছর বয়স) এর মৃত্যু হয়। ১৯১০ সালে শরৎ চন্দ্র দ্বিতীয় বার দ্বার পরিগ্রহ করেন মেদীনিপুর নিবাসী কৃষ্ণদাস অধিকারীর ১৪ বছরের বাল্য বিধবা কন্যা মোক্ষদাকে। শরৎচন্দ্র তার নাম রেখেছিলেন হিরন্ময়ী দেবী। (তার এই দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছিল ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে) বিবাহের পর এই হিরন্ময়ী দেবীকে কোলকাতায় রেখেই তিনি ১৯১৫ সালের জগনুয়ায়ী মাসে আবার মায়ানমার যাত্রা করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে “কাশীনাথ” লেখা হলেও মন্দির গল্পটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প। আর এই মন্দির গল্পটি তার সে “সময়” কুন্তলীন-পুরুস্কারে” ভূষিত হয়।
১৯১৬ সালের ১০ এপ্রিল মায়ানমারে চাকরীতে ইস্তাফা দিয়ে শরৎচন্দ্র চাকরী জীবনের অবসান ঘটিয়ে শিবপুর ফাষ্ট বাইলেন হাওড়ার বাসায় সস্ত্রীক উঠে আসেন। ১৯১৭ সালে শরৎ চন্দ্রের রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং ঐ বছরই তিনি চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পাদিত “নারায়ন” পত্রিকায় লেখাশুরু করেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের হাতে খড়ি তখন থেকেই। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস চন্দ্রনাথ ও দেবদাস ভাগলপুর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালে ইংরেজ সরকারের রৌলাট আইনের প্রতিবাদে কোলকাতায় যে মিছিল হয়েছিল তাতে শরৎচন্দ্র একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছিলেন। ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের আহŸানে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শিশির ভাদুড়ী ও নরেশ মিত্রের পরিচালনায় শরৎচন্দ্রের “আঁধারে আলো” নির্বাক ছায়াচিত্র মুক্তি লাভ করে। বলা বাহুল্য শরৎ চন্দ্র রচনার এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র সিনেমার প্রয়াস।
১৯২৩ সালে নজরুল যখন হুগলী জেলে আমরণ অনশনরত থাকাকালীন সময়ে মানব দরদী ব্যাথিত শরৎচন্দ্র তাঁকে বুঝিয়ে অনশন ভঙ্গ করবার জন্য ৭ মে জেলে দেখা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু নির্দয় জেল কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে দেখা সাক্ষাৎ করতে দেন নাই। এই বছরই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর সাহিত্যের অবদানের জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শরৎ চন্দ্রকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। ১৯২৫ সালের জুনে বালিতে (হাওড়ায়) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু উপলক্ষে আয়োজিত সভায় তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯২৬ সালের ৪ জানুয়ারি শরৎচন্দ্র “পথের দাবি” উপন্যাসের উপর চৎবধপযরহম ড়ভ ংবফরঃরড়হ এর অযুহাতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা (টহফবৎ ঝবপঃরড়হ ১২৪অ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ চবহধষ ঈড়ফব) জারি হয়। রবীন্দ্রনাথকে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তিনি পত্র মারফত অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি ঢাকার মালিকানা অভয় আশ্রমে পশ্চিম বিক্রমপুর যুবক ও ছাত্র সম্মীলনীতে শরৎচন্দ্র সভাপতিত্ব করেছিলেন ঐ বছরই ৩০ মার্চ উত্তর বঙ্গের আমাদের এই রংপুর বঙ্গীয় যুব সম্মিলনীর অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দেন এবং ঐ বছরই নরেশ মিত্র পরিচালিত নির্বাক চলচ্চিত্র দেবদাস মুক্তি পায়। ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে শরৎচন্দ্র কুমিল্লায় যুব সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন এবং ঐ বছরই ২৪ ডিসেম্বর তার প্রথম সবাক চিত্র “দেনা পাওনা” চলচ্চিত্রায়ন হয়। পরিচালক ছিলেন ছবিটির প্রেমাঙ্কুর আতর্থী (শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র বাংলা দ্বিতীয় সবাক চলচ্চিত্র)। ১৯৩৪ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি ফরিদপুর সাহিত্য সন্মেলনের মূল সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই বছরের ডিসেম্বর শেষে কোলকাতা টাউন হলে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৩৫ সালে বছরের প্রথম দিকে ২৪, আশ্বিনী দত্ত রোডে নব নির্মিত দোতলা বাড়ীতে স্ত্রী হিরন্ময়ী দেবী (২য় স্ত্রী), ছোট ভাই প্রকাশ চন্দ্র ও তার পরিবার বর্গ নিয়ে সংসার পেতেছিলেন। এই বছরেই শরৎচন্দ্রের নিউ থিয়েটার্স প্রয়োজিত প্রথমেশ বড়–য়া পরিচালিত “দেবদাস” মুক্তিলাভ করে (১৯৩৫ সালের ৩রা মার্চ) ১৯৩৬ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় উপস্থিত থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মান সূচক ডি, লিট উপাধী গ্রহণ করেন এবং ৩১ জুলাই ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। শরৎচন্দ্রের রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- বড় দিদি, বিরাজ বৌ, পন্ডিত মশাই, পল্লী সমাজ, শ্রী কান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনাপাওনা, শুভদা, পথের দাবি, বিন্দুর ছেলে, রামের সূমতি, মেজদিদি, মন্দির প্রভৃতি।
১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বের শেষের দিকে শরৎচন্দ্রের পেটে তীব্র যন্ত্রনা ও পাকস্থলীর পীড়া শুরু হয়। রোগ নির্ণয় ও সুষ্ঠ চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। অচীরেই তাঁর যকৃতে ক্যান্সার ও পাকস্থলিতে পচন ধরা পড়ে। ঐ বছরই ডিসেম্বর এর শেষ নাগাদ ৫ সাবার্ণ হাসপাতাল মোড়ে ইউরোপীয় নার্সিং হোমে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালের ১২ জানুয়ারি কোলকাতায় পাক নার্সিং হোমে ডাঃ কুমুদ শঙ্কর রায়কে অপারেশনের জন্য সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর প্রদান করেন। বলাবাহুল্য এটিই তার জীবনের শেষ স্বাক্ষর এবং সেদিনই ডাঃ ললিত বন্দোপাধ্যায় দ্বারা তাঁর পেট অপারেশন করা হয়। ১৯৩৮ সালে ১৬ জানুয়ারি (২ মাঘ, ১৩৪৪ বাংলা) রোববার, সকাল ১০টা বেজে ১০ মিনিট সময়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি কমলা লেবুর রস খেতে চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য সে আশাও তার পূরণ হয়নি। ঐ দিনই বিকেলে ৩-১৫ মিনিটে আশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়ী থেকে বিরাট শোক মিছিল করে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেওড়া তলা শ্মশানে। মরদেহ অগ্নিসংযোগ করা হয় সন্ধ্যা ৫.৫০ মিনিটে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর (১৮৭৬-১৯৩৮) খ্রীঃ।
মানব দরদী শরৎ চন্দ্রের আজ ১৪৩ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে জানাই হৃদয়ের অফুরন্ত ভালোবাসা।