অপারেশন

65

ছুটির দিন । আমরা সবাই মিলে গল্প করছিলাম । হঠাৎ মনে হলো অনেকদিন ধরে দাদুর মুখে গল্প শোনা হয়নি ।
সাবই মিলে দাদুর কাছে গেলাম । দাদু তখন পানের বাটা সামনে নিয়ে পান চিবুচ্ছিলেন। আমাদের দেখে পিক করে পানের পিকটা পাশের একটি পাত্রে ফেলে বললো, কী দাদুরা কী মনে করে আজ?
দাদু, দাদু, আমরা গল্প শুনতে এসেছি।
গল্প শুনবি? কী গল্প?
মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
তোরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে কী করবি? সেই গল্প কি আর কেউ শুনতে চাইরে দাদু?
কেন কেন? শুনতে চাইবে না কেন? সে গল্পগুলোই তো আমাদের ইতিহাসের গল্প, ঐতিহ্যের গল্প। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু কতো রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তা তো আমাদের জানা উচিৎ। আপনারা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন তারা যদি আমাদের এ সব গল্প না বলেন তাহলে আমরা জানবো কী করে।
ঠিক আছে। তোরা যখন শুনতে চাস তাহলে শোন। আজকে তোদের একটি নতুন গল্প বলি।
আমাদের পাড়ায় বেশ ক’জন কিশোর ছিলো। তারা যেমন লেখাপড়ায় ভালো ছিলো, তেমন ছিলো পরোপকারী। পাড়ার অসহায় বৃদ্ধাদের তারা বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতো। নিয়মিত স্কুলে যেতো। খেলাধুলায়ও ছিলো পারদর্শী। হঠাৎ খবর শোনা গেলো পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী তিন কিশোরের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার মতিন মাস্টারের দেখাও নেই। বেশ কিছুদিন ধরে তিনিও নিখোঁজ। ছেলে তিনটি মতিন মাস্টারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতো। স্যারের বাসায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে শুনে নিজেদের মধ্যে বাসনা জাগলো যুদ্ধে যাবার। মাস্টার প্রথমে রাজি ছিলোনা তাদের নেয়ার। দেশের প্রতি তাদের ভালবাসা দেখে মাস্টার বাধ্য হন। শপথ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার।
নিখোঁজ ছেলের সন্ধান না পেয়ে অসহায় তামিমের বাবা ছেলের টেবিলে বসে কাঁদছিলেন। তামিমেরর বইয়ে হাত বুলাতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি চিরকুট “বাবা আমার বন্ধু সিয়াম ও সাইমকে নিয়ে যুদ্ধে গেলাম। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না। যদি হয় সেদিন স্বাধীন দেশের পতাকা হাতে যেন তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি। তুমিতো বলতে, মাকে রক্ষা করা ছেলের কর্তব্য। আমরা শকুনের হাত থেকে মাকে রক্ষা করতে গেলাম”। চিরকুটটা পেয়ে তামিমের বাবার বুক গর্বে ভরে গেল।
ভারতের ত্রিপুরা থেকে ট্রেনিং শেষে কিশোরদের নিয়ে মতিন মাস্টার গঠন করলো একটি অপারেশন টিম। গা গতরে তামিম একটু বড় বলে অস্ত্রের ট্রেনিং মিললো কেবল তার। বাকি দু’জন নিয়োগ পেল ইনফরমার হিসেবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সিয়াম ও সাইম কাজ নেয় গ্রামের অদূরে পাকিস্তানি ক্যাম্পে। তারা একদিন জানতে পারে আজ রাতেই এ ক্যাম্পে একটি বড় মিটিং হবে । মিটিঙে আসবে বড় বড় আর্মি অফিসাররা। পরিকল্পনা নিচ্ছে তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেবার। বিষয়টি তারা জানায় কমান্ডারকে। রাত গভীর, চারদিকে অন্ধকার। অমাবস্যার রাত। দূর থেকে কেবল ক্যাম্পের আলো ছাড়া আর কিছ্ইু দেখা যাচ্ছিলো না। কমান্ডার প্রস্তুতি নিলেন অপারেশনের। পাকিস্তানি সৈনিকরা যখন মিটিঙে ব্যস্ত ছিলো তখন সিয়াম ও সাইম এক এক করে তাদের প্রায় অস্ত্র ফেলে দেয় পাশের ডোবায়। আর নিজেরা সরে যায় সুকৌশলে। ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে আলো জ্বালিয়ে সংকেত দেয় অপারেশন শুরুর। মাস্টারের নেতৃত্বে শুরু হয় এ্যাটাক। কিছুক্ষণ পর শুরু হয় পাল্টা গুলি। শুরু হয় যুদ্ধ। ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে মাস্টারের টিম। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে কমান্ডারের বুকের বাম পাশে। মাস্টার লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুলো মাস্টারের বুক থেকে। তামিম গায়ের জামা ছিড়ে চেষ্টা করে রক্ত বন্ধের। মাস্টারের দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। মাস্টার তামিমকে নির্দেশ দেয় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার। মাস্টার শাহাদাত বরণ করলেন। তাকে সেখানে রেখেই পেছন থেকে এসে তামিম তুলে নেয় দুই হাতে দুইটি ভারি ভারি অস্ত্র। গুলি করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে। একটি মুহুর্তের জন্যও সে বন্ধ করেনি ফায়ারিং। ক্যাম্পের অপর প্রান্ত থেকে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সাইম ও সাইম তুলে নেয় দুটি অস্ত্র। তারাও শুরু করে এ্যাকশান। এদিকে ক্যাম্পের দুই পাশ থেকে ফায়ারিং শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাধ্য হয় আত্মসমর্পণে।পরাস্ত হয় পাকিস্তানি আর্মিরা। জ্বালিয়ে দেয়া হলো ক্যাম্প। শত্রু মুক্ত হলো গ্রাম। কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না মাস্টার। অপারেশনটির নাম দেয়া হলো কিশোর অপারেশন। এরকম কতো কিশোর, তরুণ, যুবক ছাত্র, কৃষক শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন হলো আমাদের বাংলাদেশ। আমরা পেলাম একটি স্বতন্ত্র মানচিত্র। বিশ্ব মানচিত্রে এক খণ্ড বাংলাদেশ, একটি লাল সবুজের পতাকা।