অপরাধ : রাষ্ট্র এবং রাজনীতি

45

ঘনঘোর সংকটে তমসাচ্ছন্ন পৃথিবী। মানুষ দিকবিদিক অসহায়। গোটা পৃথিবী প্রত্যাশা নিয়ে দিন গুনছে কখন কাটবে সংকটের এই আঁধার। নিয়মিত হাতধোয়া ও শারীরিক দূরত্বের অনিয়মিত অভ্যাসে আটকে পড়েছে মানুষ। গোটা পৃথিবী ‘করোনা’ নামের এক অদৃশ্য শত্রূর সাথে লড়ছে। আমরাও লড়ছি। আমাদের লড়তে হচ্ছে অদৃশ্য এবং দৃশ্যমান উভয় শত্রূর সাথে। করোনাূ অদৃশ্য। কিন্তু দারিদ্র্য দৃশ্যমান। বেকারত্ব দৃশ্যমান। অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ দৃশ্যমান। পাটকল শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা শ্রমিকদের বেতন-ভাতার আন্দোলন দৃশ্যমান। চিকিৎসা সেবার আকুতি দৃশ্যমান। দুর্নীতি দৃশ্যমান। সন্ত্রাস দৃশ্যমান। ধর্ষণ দৃশ্যমান। সামাজিক অবিচার দৃশ্যমান। সর্বোপরি এসবের সামগ্রিক বর্গ রাষ্ট্রীয় অনাচার দৃশ্যমান। আমরা দুই প্রতিপক্ষের সাথে লড়ছি। একপক্ষ বৈশি^ক মহামারী করোনা। এবং অপর পক্ষ অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় অনাচার। অদৃশ্য প্রতিপক্ষ মহামারী ভাইরাস এবং দৃশ্যমান রাষ্ট্রীয় অনাচার উভয়ই জাতি ও রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নে বাধা। ভাইরাস দেহের দ্রুত বিনাশ নিশ্চিত করছে আর অনাচর ও দুঃশাসন একটি সমাজ বেঁচে থাকার মূল নির্যাস কেড়ে নিচ্ছে। এখন যেমন আমরা মহামারী দেখছি, ঠিক একইভাবে আমাদের আগেকার প্রজন্মও এমন সংকট দেখেছে। বিভিন্ন রোগ-জীবাণু বার বার আক্রমণ করেছে পৃথিবীকে। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে রোগ-জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। সভ্যতা কখনো একই স্থানে স্থির থাকেনি। চলমান মহামারী সংকট একসময় আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সক্ষম হব। কিন্তু আমরা যে অনিয়ন্ত্রিত অপরাধের সমাজ গড়ে তুলেছি তার লাগাম কে টানবে! আমাদের সমাজ দিন দিন অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে। পত্রিকার পাতা খুলতেই চোখে পড়ে অপরাধের নানা ধরন। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা প্রতিদিন ঘটছে না। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, বস্তিপাড়া থেকে থেকে আবাসিক, লিঙ্গ-বয়স নির্বিশেষ সর্বত্র যেন নৃশংসতা আর ভয়াবহার প্রতিযোগিতা। অপরাধপ্রবণ সমাজে আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আমরা শ্বাস নিতে পারছিনা। উয়্যি কান্ট ব্রিদ! রাষ্ট্র ব্যক্তির বৃহত্তর পরিধির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠলে অপরাধের সংক্রমণ ঘটে ব্যক্তি এবং তার চরিত্র প্রকাশের সম্মিলিত ইউনিট সমাজে। কারণ ব্যক্তি ও ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাষ্ট্রে ব্যক্তি নয়, ব্যবস্থায় ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাষ্ট্র অপরাধপ্রবণ হলে ব্যক্তির মধ্যে একই প্রবণতা রেখাপাত করবে। এটা ঘটবে রাষ্ট্রের বিদ্যমান চরিত্রকে অনুসরণের মাধ্যমে অথবা প্রতিরোধের তাগিদে। অপরাধপ্রবণ রাষ্ট্রের কাছে অপরাধের লাগাম টানা কঠিন। রাষ্ট্র অপরাধপ্রবণ হলে সমাজ বাস্তবতায় বিদ্যমান নানা অপরাধেরও থাকে রাষ্ট্রনৈতিক দায়। রাষ্ট্রনৈতিক দায়কে পাশ কাটিয়ে কেউ যদি অপরাধের বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে তৎপর থাকে, তবে তা হবে সেই শুভঙ্করের ফাঁকি! রাষ্ট্র কি কি অপরাধ করে? তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড রাষ্ট্রের অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে গণমাধ্যম এবং ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরন করা রাষ্ট্রের অপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিবেচনায় আইনের অপপ্রয়োগ রাষ্ট্রের অপরাধ। বিনা অপারাধে ও বিচারের নামে প্রহসনমূলক আচরণ রাষ্ট্রের অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের সেবক বানাবার পরিবর্তে, প্রতিপক্ষ বানানো রাষ্ট্রের অপরাধ। সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিতের পরিবর্তে, হিন্দু-মুসলমান, আহমদী-কাদিয়ানী, পাহাড়ি-বিহাড়ি, বাঙালি-অবাঙালি ইত্যাদি ইত্যাদি ভাগে বিভাজিত করা রাষ্ট্রের অপরাধ। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, একটা রাষ্ট্র অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে যা যা প্রয়োজন তার সবটুকু উপাদান আমাদের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটিতে বিদ্যমান। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার-তথা জনযুদ্ধের আকাক্সিক্ষত জনচেতনা নির্মাণে ব্যর্থ রাষ্ট্রটি আমাদের জন্য তিক্ত বাস্তবতায় বটে!
আমরা যে অর্থে বস্তুর অস্তিত্বগত আকার বুঝি, সে অর্থে রাষ্ট্র একটি নিরাকার প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র দেখা যায় না, ছোয়া যায় না তথাপি এটি অপরাধ কিভাবে করে? রাষ্ট্র মূলত অপরাধ সংঘটিত করে ‘আইন’ এবং রাষ্ট্রের নিযুক্ত ‘আইনি কর্মচারী’ দ্বারা। অর্থাৎ যাঁরা বিভিন্ন কর্মে নিযুক্ত থেকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। রাষ্ট্রতাত্তি¡কদের ভাষায়, “State crimes are acts as defined by law as criminal and committed by state officials in the pursuit of their job as representative of the state”। সংগত কারণে প্রত্যেক গণবিরোধী আইন এবং আইনের প্রয়োগকারীরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে।
আমরা দেখছি বিচারহীনতা অথবা অবিচারের সংস্কৃতি আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমন একটা সিস্টেমের মধ্যে আমরা বসবাস করছি, যেখানে ভুক্তভোগী মনে করছে আইন তাঁর জন্য নয়। আর অপরাধী মনে করছে আইর তাঁর কি করতে পারে! অবিচার যখন একটা সমাজের আদর্শ হয়ে পড়ে তখন অনাচারীদের দাপটে সাধারণ মানুষ ভীত-বিহব্বল থাকে। আইন তার সঠিক গন্তব্য হারিয়ে প্রভাবশালীদের অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার কাছে কুক্ষিগত হয়ে গেলে সাধারণ মানুষ নিজেদের অসহায় বোধ করে। সাধারণ মানুষ অসহায়বোধ করলে ক্ষমতার দাপুটেরা আরও নির্ভয়ে নিপীড়ক হয়ে উঠে। ক্ষমতার বিকারের ফলে বাংলাদেশ অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি নোয়াখালীতে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় স্থানীয় নেতা দ্বারা এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ধর্ষণ নিয়ে নতুন করে আলোচনা, প্রতিবাদ, আন্দোলন চলছে। ধর্ষণ বাংলাদেশে ঘটে চলা সবচেয়ে ঘৃণ্যতম অপরাধগুলোর একটি। জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় আরও নানা উন্নয়নের ফিরিস্তির মধ্যে প্রদীপের নিচে অন্ধকার ধর্ষণ থেকে দলধর্ষণের ক্রমোর্ধ্বমান উন্নয়ন মানুষ হিসেবে আমাদের লজ্জায় আড়ষ্ট করছে। ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ নিয়ে সমাজে নানা মত ও আলোচনা জারি আছে। সুধী সমাজের কেউ কেউ ধর্ষণকে সামাজিক ব্যাধি (Social Disease) কিংবা নিছক নৈতিক অবক্ষয় (Ethical Degenerate) আকারে উপস্থাপন করে, ক্ষমতার বিকার এবং রাজনৈতিক প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করেন। ধর্ষণ যেমন নৈতিক অবক্ষয়ের সামাজিক দিকটি সামনে আনে, একই সাথে যে দিকটি গুরতরভাবে উন্মোচন করে তা হলো, রাষ্ট্রের অপরাধপ্রবণতার সংযোগে ফুলেফেঁপে উঠা ক্ষমতার বিকার। সহজভাবে বললে, বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রধানতম কারণ ‘ক্ষমতা’। ধর্ষক কারা এবং কিভাবে করে এ দুই জিজ্ঞাসার সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করলে ধর্ষণের মৌলিক সমস্যা আমরা ধরতে পারব। যাঁরা ধর্ষক বেশিরভাগই (শতাংশের হিসেবে যা ৯৮ জন) কোন না কোনভাবে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। এবং ভিকটিম কোন না কোনভাবে ক্ষমতায় পিছিয়ে থাকা সমাজের দুর্বল প্রতিনিধি। ক্ষমতার শ্রেণী বিন্যাস করলেমাটাদাগে তিনটি স্তর পাওয়া যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থবিত্ত, পেশি। এই তিনস্তরের ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে দলতন্ত্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ করছে নারীকে। ধর্ষক বিকৃতকামনা চরিতার্থ করার পূর্বে তাঁর মনোজগতে সেট করে নেয় সমাজ, আইন বা তাঁকে প্রতিরোধের নানা ধারা তাঁর নিয়ন্ত্রণে। অপরাধ করে নিস্তার পাওয়ার মনোজাগতিক কল্পনা এবং বাস্তবতা অপরাধীকে আরও বেশি অপরাধী হতে প্রলুব্ধ করছে। ধর্ষণ কেন দলতন্ত্রীয় ক্ষমতার বিকার এটা আরও স্পষ্ট হবে নিকট অতীতের কিছু ঘৃণ্য উদাহরণ দেখলে। ১৯৯৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে দলগত ধর্ষণ, ১৯৯৮ সালে উল্লেখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দীন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি। ২০০০ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঁধন নামে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করা, ২০০১ ও ২০১৯ সালে দুইটি ভিন্ন রাজনৈতিক দরের শাসনামলে পছন্দের দলকে ভোট দেয়ার কারণে পূর্ণিমা, নফুজা, রহিমা, পারুল ধর্ষণ এবং সর্বশেষ ২০২০ সালে জনালোচিত সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন। এসব ঘটনা ক্ষমতার দুষ্টুচক্রকে সাধারণের কাছে বোধগম্য করে। বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের শাসনামলে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা মিডিয়া কাভারেজ পাওয়া এবং দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় তোলার কারণে উল্লেখ করলাম। ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া আরও শত শত ধর্ষণ প্রচারমাধ্যমে আসছেনা ফলে জনালোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। উপর্যুক্ত ঘটনাসমূহ কোনো একক কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসব ঘটনা তিপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলে ক্ষমতার বিকারের ফলে ঘটে চলা সব অপরাধের তাৎপর্যগত ভাবার্থের বাস্তবতা। আমাদের এখানে যাদের ক্ষমতা থাকে তারা বিচারহীনতার এডভান্টেজ নেয়। বিচারহীতার সুযোগ পেয়ে তাঁরা ধর্ষণের মতো নানা অপরাধ করতে প্ররোচিত হয়। এসব অপরাধবান্ধব ক্ষমতাবান শ্রেণী তৈরিতে সবচেয়ে বেশি দায়ী আমাদের দুর্বৃত্তায়নের দলীয় রাজনীতি। দল যেখানে কর্মী-নেতাকে শেখানোর কথা আদর্শ, নীতি, জনকল্যাণ, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা, সেখানে দলগুলো হয়েছে অনাদর্শের ভাগাড়। কর্মী-নেতারা দল থেকে শিখছে লুটপাট, খুনোখুনি, নিপীড়ন, শোষণ, আধিপত্য। অর্থাৎ সমাজে ক্ষমতা প্রয়োগের সবরকম সূত্র। দলগুলো যতদিন রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন তথা ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করে জনচেতনার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে ফিরতে পারছেনা, ততদিন ক্ষমতার বিকারের ফলে চালু হওয়া অপরাধী তৈরির উৎপাদন যন্ত্রটি চলতে থাকবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট