অন্তঃসলিলা দহন-দ্রোহের জীবন ভাষ্য মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন

272

“আমার সৃষ্ট পথে আমি পথিক। হাঁটছি-
আমার সৃষ্ট নদীতে আমি নাবিক। ভাসছি-”
-মাটিয়াল, সেলাইশিল্পের সুদিনে
কবি রুহুল কাদের-এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “সেলাইশিল্পের সুদিনে” আধুনিক বাংলা কাব্যে একটি অনন্য সংযোজন। একুশে বইমেলা ২০২০ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ৫৬ পৃষ্ঠার শোভন বইটির ৫০ সংখ্যার সর্বশেষ কবিতা “মাটিয়াল” পড়ে বেশ চমৎকৃত হলাম। আসলেই কবি একজন দক্ষ ‘মাটিয়াল’ (মেইট্টাল- চট্ট. আঞ্চলিক)। তিনি শব্দের মাটিয়াল। কোদাল দিয়ে খুঁড়ে বের করেন শব্দের আকরিক। সে আকরিক মাথায় নিয়ে গড়ে তোলেন স্বপ্নের কাব্যপিরামিড; জয় করেন কাব্যরাজ্য; আর ঘোষণা করেন-
“প্রবাদের মতো
মানুষেরা জানে কবি খুঁজে জীবনের জল-অনলের অঞ্জলি, রঙিন অক্ষর” -কবি: এক
“কবিতার কারখানা বানাবো, টাকা নয়
শব্দ নেবো ঋত। মন্দা বাজারে হয়ে গেলে দেউলিয়া
হাতকড়া দিয়ে নিও না দমবন্ধ কারাপ্রকোষ্ঠে” – কবি: দুই
অতঃপর তিনি স্লোগান তোলেন we shell overcome– আমরা করবো জয়।
কবি রুহুল কাদের একজন স্বল্পভাষী, গুণী, সজ্জন অধ্যাপক এবং রেডিও-টিভির সাহিত্য আলোচক ও নীরব সাহিত্যসাধক। কবি একজন গল্পকারও বটে। তার লেখার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘কক্সবাজার বিচিত্রা’ নামক সাহিত্য (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০০১, ৮ম সংখ্যা) পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প ‘অতল অন্ধকারে’ পড়ার মাধ্যমে। গল্পপাঠে বুঝে নিয়েছি তিনি একজন শক্তিমান লেখক। পরে গল্পগ্রন্থ ‘দহনদ্রোহ’ পাঠে তার লেখার প্রতি আরও আস্থাশীল হয়ে পড়ি। আধুনিক গদ্যকবিতার রসোদ্ধার করা আমাদের মতো সাধারণ পাঠকের পক্ষে চরম কষ্টকর। তাই অনেক সময় কবির বক্তব্যের সাথে আমাদের বোধের তারতম্য ঘটে থাকে। তাই এ গ্রন্থ আলোচনার শুরুতেই আমার সে দৈন্যকে স্বীকার করে নিচ্ছি।
কবি রুহুল কাদেরের কাব্যঅন্বেষা বহুমাত্রিক। তার প্রখর কাব্যিক দৃষ্টি থেকে বাদ যায়নি সুই থেকে সুতো, মুখোশ থেকে ডিডেলাস-ইকারুস-এর মিথ (সুঃয) পর্যন্ত। বাদ পড়েনি আধুনিক যুগযন্ত্রণার নাগরিক সুখ-দুঃখ, হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি। একাব্যে তিনি স্বচ্ছন্দে এঁকেছেন ওসব কিছুর আবহের বাণীচিত্র। তার কাব্যের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে একটি সূ² জিজ্ঞাসা- ‘মনুষ্যত্ববোধ’। এ মনুষ্যত্ববোধ তিনি লালন করেন আবাল্য। এটি যেন তার কাব্যিক সত্তা। এ সত্তার বিপরীতে মিথ্যার উল্লম্ফন তিনি কখনও সহ্য করতে পারেন না। তাই দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-
“আমাদের ঝোপজঙ্গল বীর গেরিলার অভয় তাঁবু। জলপাই
পোশাকঢাকা শরীরের বুকে রক্তমন্ত্র একাত্তর,
অসংখ্য তিতুমীর বাঁশের কেল্লায় বুক চেতিয়ে উড়ায় সাহসের পতাকা
মেলাপার্বণে বারমাসি গানে দুলে বাউলবাঙালির অন্তর।” – স্বর্গপুরাণ
“সেলাইশিল্পের সুদিনে” একটি নাম কবিতা। বইটির নামকরণে কবি হয়তো একটি উপলক্ষকে সামনে নিয়ে এসেছেন। সমাজ-জীবনে যেমন উৎসব ও পালা-পার্বণকে উপলক্ষ করে পণ্য শিল্পীরা স্ব স্ব পণ্য উৎপাদনের মৌসুম হিসেবে গণ্য করেন, তেমনি সাহিত্যকর্মীরা তাদের সাহিত্যকর্ম প্রকাশের সোনালি মৌসুম হিসেবে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মাসকে নির্দিষ্ট করে থাকেন। এ মৌসুমে শিল্পী-সাহিত্যিকগণ স্ব স্ব শিল্পকর্ম বিনির্মাণে নিবিষ্ট থাকেন। কবি রুহুল কাদেরও হয়তো সে সুযোগটি গ্রহণ করে কাব্যগ্রন্থটির এ নামকরণ করেছেন।
কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন দাদা আমজাদ আলী সিকদার ও কনিষ্ঠ চাচা লিয়াকত আলী সিকদারের স্মরণে। বইটির কোনো ভূমিকা নেই। থাকলে কবির কিছু বক্তব্য ও কৈফিয়ত পাঠক জানতে পারতো। সাধারণত প্রথম প্রকাশে কোনো বইয়ের মুদ্রণত্রæটি থাকাটা অসম্ভব নয়। কিন্তু আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটিতে মুদ্রণপ্রমাদ আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। এ জন্যে কবিসহ মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশংসার দাবীদার। ঝকঝকে ৮০ গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপা বোর্ড বাইন্ডিং ও ম্যাট লেমিনেটেড জ্যাকেট পেপারে মোড়ানো বইটি প্রথম দৃষ্টিতে সবার দৃষ্টি কাড়ে। প্রচ্ছদে আধুনিকতার ছোঁয়া ও (বিমূর্ত শিল্প)-এর স্বচ্ছন্দ প্রকাশ লক্ষণীয়। তবে রঙের বিন্যাস ও প্রচ্ছদ-গ্রাউন্ড সাদামাটা হওয়ায় পাঠকের প্রথম দৃষ্টি-আকর্ষণী ম্লান হতে পারে। কারণ love at first sigh বলে যে একটি মত প্রতিষ্ঠিত আছে, তা এক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত।
কবির কাব্যদক্ষতার মূল্যায়নে গ্রন্থের প্রথম ফ্ল্যাপে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষক হাফিজ রশিদ খান যে বক্তব্য প্রকাশ করেছেন তা যথার্থ। পাঠকের তৃষ্ণা নিবৃত্তে তার মূল্যায়নটি হুবহু উদ্ধৃত করা হলো: “রুহুল কাদেরের কবিতাজোয়ার কূলপ্লাবী হয়েছে। এই ভরাযৌবনা মাতাল করেছে। ভাসিয়ে নিয়েছে তীরের সবুজদুর্বার শেকড়সমেত ঘরবসতি। যদি ঠাঁই মেলে নতুন পলির কৃপায়, তবেই দাঁড়াবে সে আবার। এমনতর শান্ত ও সম্ভ্রান্ত শব্দবিহার এ কবির। আয়াত এবং মন্ত্রের মতো ঘিরে-ঘিরে চলে। ধীরে ধীরে বলে। সুদীপ্ত সুন্দরের বুকে টোকা দেয়। ক্রুদ্ধ ও বেতমিজ এই লোলজিব সভ্যতার ভেতরে সন্তের গাঢ়বাণী খোদিত করে। ফালা-ফালা করে দেখিয়ে দেয়: ‘চেহারার ক্ষত ও খুঁতে সুরভি প্রসাধনী মেখে/ সময়ের গডুকা ডাকে শরীরী মেদে ও ক্লেদে/ আত্মার পরিতৃপ্তির তীর্থ কোথায়?’ এই কবি নতুন, রঙিন সুতোয় সেলাই করবেন নতুন বসন। এই জীবন আর তার ভেতরের মননখনন সেরে সাগ্নিক ঋষির ধরনে পোড়াবেন জীর্ণতার ছাল-বল্কল। ভাষা আর উপমায়, সান্দ্র বয়ন আর বয়ানে রুহুল কাদের আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। গুপ্তধন আবিষ্কারের উল্লসিত আসমান পেলাম তার কবিতায়।”
কাব্যগ্রন্থটির আলোচনা করার আগে কবিতা ও আধুনিক মুক্তছন্দ বা গদ্যছন্দ সম্পর্কে দুটি কথা বিবৃত করা আবশ্যক বলে মনে করি। নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজ লোজানো (১৯১৪-১৯৯৯) কবিতার সংজ্ঞায় বলেন- “কবিতা হচ্ছে সেসব কথামালা, যা মানুষের মনের মাঝে মোচড় দিতে পারে।” কবিতা হলো- “A forgetfulness of evils and truce from cares” অর্থাৎ “কবিতা হলো একটি খারাপ বিস্মৃতি এবং দুর্ভাবনা থেকে যন্ত্রণানিবৃত্তির উপায়।” আবার কেউ কেউ বলেন, কবিতা হলো ‘শোকের মলম’। (দ্র: আধুনিক কবি ও কবিতা : হাসান হাফিজুর রহমান)।
কবিতার প্রাণ হলো ভাব, ভাষা, রূপক, প্রতীক, আঙ্গিক ও ছন্দের বৈচিত্রময় ব্যবহার। এই রূপক ও প্রতীক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতার মধ্যে ‘ছবি’ কবিতা; ইংরেজ কবি কীটস-Ode to a Nightingle; টি.এস এলিয়টের The waste land বা ‘পোড়ো জমি’; ফকির লালন শাহ’র প্রচুর কবিতা গানে প্রতীক ও রূপকের ব্যবহার; কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ব্যবহৃত সর্বহারা ও বুভুক্ষু মানুষের জীবনের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক ‘পূর্ডুমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’; কবি ফররুখ আহমদের ‘ডাহুক’ ও ‘পাঞ্জেরি’। উর্দু সাহিত্যের মহাকবি আল্লামা ইকবাল তাঁর সাহিত্যে ‘শাহীন’ বা বাজপাখিকে প্রতীক করে তুলেছেন জাতীয় জাগরণের নিয়ামক হিসেবে।
আধুনিক কবিতার মূল বিবর্তন এসে স্থিত হয়েছে গদ্যছন্দে। গদ্যছন্দেই লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন আধুনিক কবিরা। তাই ছন্দ ও ছন্দের উপকরণ সম্পর্কে দুটি কথা না বললেই নয়। ছন্দ: কাব্যের রসঘন শ্রতিুমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তা-ই ছন্দ। (বাংলা ছন্দ: জীবেন্দ্র সিংহ রায়) আর ছন্দের উপকরণ হলো: অক্ষর, যতি বা ছন্দযতি, পর্ব, মাত্রা, শ্বাসাঘাত, পদ ও চরণ, স্তবক এবং মিলবিন্যাস।
গদ্যছন্দের বৈশিষ্ট্য হিসেবে নিম্নের বিষয়গুলোকে উল্লেখ করা যায়: “(ক) গদ্যছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেনÑ গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রঙ ধরানো হয়, তখন গদ্যকবিতার জন্ম হয়, (খ) পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়, সাধারণত পর্বদৈর্ঘ্যে কোনো ধরণের সমতা বা মিল থাকেনা, (গ) পদ ও চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বিরাম চিহ্নহ্ন বা ছেদ চিহ্নেহ্নর দ্বারা নির্ধারিত হয়; এই বিরাম চিহ্নহ্ন বা ছেদ চিহ্নহ্ন উচ্চারণের সুবিধার্থে নয়, বরং অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়, (ঘ) কবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরণের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়, (ঙ) গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও এর পদবিন্যাস কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ও পুনবিন্যাসিত হয়।” (মাসিক সত্যের দর্পণ, সেপ্টেম্বর ২০১৮, অনলাইন)
কবি রুহুল কাদের তার এ কাব্যে আধুনিক গদ্যছন্দ বা মুক্তছন্দের বহু মাত্রিক গবেষণা চালিয়েছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্যছন্দ নিয়ে বলেছেন, “গদ্যই হোক, পদ্যই হোক, রসরচনা মাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে। পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ, গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত। সেই নিগূঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয়। গদ্যছন্দবোধের চর্চা বাঁধা নিয়মের পথে চলতে পারে, কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণবোধ মনের মধ্যে যদি সহজে না থাকে অলঙ্কারশাস্ত্রের সাহায্যে এর দুর্গমতা পার হওয়া যায় না। অথচ অনেকেই মনে রাখেনা যে, যেহেতু গদ্য সহজ সে কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয়।” [কাব্য ও ছন্দ (১৯৩৬), পৃ: ২৭] আরেকটু সহজ করে বললে গদ্য কবিতার ছন্দের দৃষ্টান্ত এভাবে দেওয়া যায়, “সাগরে একটার পর একটা ঢেউ উঠে, ঢেউ ভাঙে; বড় ঢেউয়ের মাঝে আবার ছোট ছোট ঢেউ তালে তালে বড় ঢেউয়ের সমান্তরালে মিশে যায়, গদ্য কবিতার দৃষ্টান্তটাও তেমনি।” (গদ্য কবিতা ও ছন্দনিপুনতা, খন্দকার ফিরোজ আহমেদ, বৈচিত্র নিউজ২৪.কম, অনলাইন পত্রিকা)
বিশিষ্ট সাহিত্য আলোচক মহিউদ্দিন আকবর বলেন, “বর্তমানে রূপক ও প্রতীক ব্যবহার শুধু আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন, অসহিষ্ণুতা, মানস-সংকট, আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা, নানাবিধ ইজম, উপলব্ধি, জীবনচেতনা ও অন্বেষার মধ্যেই সীমায়িত নেই। রূপক ও প্রতীকের প্রসার ঘটেছে বহুজাতিক যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তি, টানটান আন্তঃরাজনৈতিক স্নায়ুসংকটসহ নৈতিক অবক্ষয়ের তাড়নায় মহাজাগতিক লড়াইয়ের প্রান্তর অবধি।” (গদ্য কবিতা এবং কবিতা নির্মাণ সাফল্য নিরূপণের বিষয়াদি- মহিউদ্দিন আকবর, দৈনিক জনতা, ০৯/০২/২০১৪)।
উপরিউক্তি আলোচনা ও উদ্ধৃতির আলোকে বিচার করলে কবি রুহুল কাদের-এর “সেলাইশিল্পের সুদিনে” কাব্যগ্রন্থকে আমরা একটি আধুনিক কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। এ গ্রন্থে কবি শব্দ সন্নিবেশ করেছেন চেখে চেখে, মেপে মেপেÑ যেন কোনো যন্ত্রের কারিগর নাট-বল্টু ফিট করেছেন নিপুণ হাতে। কবির শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস ও যতির ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত। চরণের মাঝখানে পূর্ণচ্ছেদ ঘটিয়ে আরেকটি নতুন চরণ সৃষ্টি কবির দক্ষতার পরিচায়ক। কবিতায় ভাবের পরম্পরা ঠিক রেখে আরেকটি নতুন প্যারা সৃষ্টিতেও তিনি বেশ দক্ষ। গ্রন্থের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অভিনবত্ব হলো, কবির শিল্পসম্পত আধুনিক শব্দের সুচারু ব্যবহার। কিন্তু এটি সহজ নয়। এ সহজ না হওয়া বিষয়টিকেই কবি সহজ করার চেষ্টা করেছেন ‘সেলাইশিল্পের সুদিনে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায়। প্রতিটি কবিতায় প্রতিটি শব্দই যেন কবিমনের দ্রোহ ও জিজ্ঞাসার এক একটি জ্বালামুখ। কবিতায় নতুন আঙ্গিক সৃষ্টিতে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি তার কাব্যে চমৎকার সব প্রতীক, রূপক, আঙ্গিক ও ছন্দবৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন- যেটি “সব মানুষের মনের মাঝে মোচড় দিতে পারে।”
কবি যখন বলেন,
“ঘোলাটে আঁধারে নিখুঁজ হয়ে যাই-
নখ দেখি। নখর নয়। খামছে ধরা পিশাচের
অবিরাম থাবায় ঝলসে যায় মাংস ও মুখ
আমার ওষ্ঠ, অধরে দৈনিক ধ্বনিত হয় জীবনের মুক্তির ইশতেহার
বুকের মিছিলে ওঠে সবুজ লোহিতাভ স্বপ্নের ঢেউ
রাজপথ প্রদক্ষিণ করে
খুঁজে খুঁজে সম্প্রীতিসুবোধ
অনার্য মানুষ ন্যায্য রাজত্ব চাই।” Ñনোনা ঘ্রাণের মানুষ
এ কবিতায় কবির অনার্য মানুষের ‘ন্যায্য রাজত্ব’ চাওয়ার দৃপ্ত অঙ্গীকারই পাঠকের মনের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে।
এত কথা বলার পরেও একটি কথা থেকে যায়। আর তা হলোÑ “সেলাইশিল্পের সুদিনে” কাব্যগ্রন্থটি সাধারণ পাঠকের সাহিত্যরস আস্বাদনে সক্ষম হবে কিনা জানিন। তা সাধারণ পাঠকের কাছে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ পাঠে রসোদ্ধারের মতো কঠিন > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
হবে বলে মনে হয়। কারণ কবি এখানে শব্দ নিয়ে খেলা করেছেন, কবিতার আঙ্গিক নিয়ে ভিন্ন গবেষণা চালিয়েছেনÑ যা একজন সহজ-সরল সাধারণ পাঠকের কাব্য রসাস্বাদনের দৈন্যকে পরিহাস করে। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে দীর্ঘদিনের একটি লালিত অপবাদ ‘দুর্বোধ্যতা’ প্রথমদৃষ্টে এ কবিতাগুলোকে আচ্ছন্ন করে। “সাধারণ পাঠক অন্ত্যমিলকেই প্রধানত কবিতার ছন্দ বলে ধারণা করে থাকেন। তারা মনে করেন, যে কবিতায় অন্ত্যমিল থাকেনা তা-ই বোধহয় গদ্য কবিতা। প্রচলিত ধারণা অনুসারে মাত্রা, যতি, পর্ব ইত্যাদি যথাযথভাবে অনুসৃত হলেও অন্ত্যমিল না থাকলে তা কবিতা হয়নি বলে ধরে নেয়া হয়।” আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোও প্রথমদৃষ্টে তা-ই মনে হবে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘অর্থব্যক্তি’ ও ‘প্রাঞ্চলতা’কেই রচনা বা সাহিত্যকর্মের প্রধান দুটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন (রচনার শিল্পগুণ)। এক্ষেত্রে আধুনিক কবিগণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে অনেকক্ষেত্রে তা এড়িয়ে যান। ফলে শিল্পসফল অনেক কাব্যও সর্বস্তরের পাঠকের মন জয় করতে পারে না। তাই সাধারণ পাঠকের জন্য কবির কাব্যচাতুর্য আরও উদার হওয়া উচিত বলে মনে করি। তবে কবিতাগুলো একটু চিন্তাশীল, ঝানু কাব্যপ্রেমী ও উন্নত ভাবধারার পাঠকের মনের খোরাক জোগাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। “কিন্তু বোদ্ধা পাঠক এবং প্রকৃত কবিতা নির্মাতারা জানেন, অন্ত্যমিলহীন এসব গদ্য-উচ্চারণও মনের গহিনে অসাধারণ ছন্দের দ্যোতনা জাগায়।” (গদ্য কবিতা এবং কবিতা নির্মাণ সাফল্য নিরূপণের বিষয়াদি- মহিউদ্দিন আকবর, দৈনিক জনতা, ০৯/০২/২০১৪)। আর পাঠককে কবিতার ভাবোদ্ধারে একটু পরিশ্রম স্বীকার তো করতেই হবে।
কবির কবিতা থেকে শরণ নেয়া যাকÑ
“কখনও ভাবি জগতের সমস্ত আরশি লোহায় বানালে
ভালো হতো। ভঙ্গুর কাচের আরশিতে ভেসে উঠে বিবর্ণ মুখ
সময়ের সবজিতেও বিষ। কার্বনসিসা থেকে
টানা নিশ্বাসে খসে যায় প্রতিনিয়ত অগণন স্মৃতিকোষ।” Ñআকুল মাছরাঙা
এ কবিতায় দুটি খন্ডিত চরণ ‘জগতের সমস্ত আরশি লোহায় বানালে’ এবং ‘সময়ের সবজিতেও বিষ’- পাঠকের মনে নতুন ভাবের দ্যোতনা জাগায়। কবি লোহাকে আরশি এবং কালপ্রবাহে বিষ ঢেলে পাঠকের বোধশক্তিকে ঝালাই করার প্রয়াস পেয়েছেন।
“সেলাইশিল্পের সুদিনে” এ কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতা। কবি এ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন, মিথ্যার খরস্রোত সত্যের অবদমন প্রচেষ্টার দাম্ভিকতা। কবি জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন, “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/ যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা:/ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।” (অদ্ভুত আঁধার এক : জীবননান্দ দাশের অন্যান্য কবিতা)। সামাজিক কদর্য বিষয়টি কবি জীবনানন্দ দাশ উপলব্ধি করেছিলেন আজ থেকে বহু দিন আগে। সেটিরই সম্প্রসারিত আধুনিক ভাব কবি রুহুল কাদের ব্যক্ত করেছেন এ নাম কবিতায়। তবে তিনি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তার থেকে মুক্তিকৌশল শেখায় অধিকতর প্রতিশ্রুতিশীল হয়েছেন। কবি বলেন-
“বিরুদ্ধ শোরাগোলে ভাবি, শেলাইশিল্পের সুদিনে
শিখে নেওয়া জরুরি নিজের অবগুণ্ঠন বুননকৌশল,
এমন কড়া ঝড়ো দিন-ঝমঝম বজ্রপাতে
সত্য ঝলসে যায়।
*** *** *** ***
কে না জানে মিথ্যার খরস্রোত নাশিখলে সাঁতার
যুগে যুগে হেমলকের ঢেউয়ে ডুবে সব সক্রেটিস।” – সেলাইশিল্পের সুদিনে
‘অবাধ স্বাধীনতা ভালো নয়, তবু স্বাধীনতা থাকা চাই’- এ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে কবি লিখেছেন ‘উড়ে ইকারুস’ শীর্ষক কবিতা। এ কবিতায় কবি স্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। সে জয়গানকে পোক্ত করতে তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ডিডেলাস-ইকারুসের সুঃয-এর ওপর। তাই তিনি উচ্চারণ করেন-
সীমার উপরে উড়ো না, কড়ারোদে পুড়ে যাবে ডানা
নেমো না অধিক নিচে সমুদ্রের জলশ্বাসে খোয়াবে পালক
কারিগর ডিডেলাস, ডানা পেলে
মানুষেরা হয়ে যায় পাখির অধির উড়ালপ্রবণ।
*** *** *** *** ***
হা পিতা ডানার কারিগর, তবুও ক্লান্তিহীন বানাও মুক্তির ডানা
ইকারুস উড়–ক
পুড়–ক, লাগবে না নিরর্থক জীবনবিমা” -উড়ে ইকারুস
এ গ্রন্থে রোমান্টিক কবিতা অপ্রতুল। তবে ‘দৃষ্টির ঢেউ’ কবিতাটিতে কিছুটা রোমান্টিকতা নিহিত রয়েছে। উদাহরণ দিলে তা পাঠকের কাছে আরও বেশি বোধগম্য হবে বলে মনে করি।
“দুই চোখের ভেতর নোনাজলের অথৈ সাগর
ভুরুর সৌকর্যে মুগ্ধ হলে কেবল!
যত টানা দীঘল তত সুখ ছলছল
তৃষ্ণাবিন্দু টলটল;
অন্তরে সফেন দৃষ্টির ঢেউ
ঢেউয়ে ঢেউয়ে আগুন জ্বলে
নোনা ঢেউয়ে ভিজে ভিজে পুড়ে যায় কেউ।” Ñ দৃষ্টির ঢেউ
কবি দয়িতার প্রতি মুগ্ধতাকে নিখুঁতভাবে এ কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘নোনাজলের অথৈ সাগর’ বলে মানসপ্রিয়ার যে দৃষ্টান্ত কবি দিয়েছেন, তা একটি জনপ্রিয় গানের কলিকে স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ ‘চোখ তো নয় যেন সাগর দুটি পাপাশাশি’। কবিতার শেষের চরণ তিনটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবি এখানে প্রেমাষ্পদের আকর্ষণে ‘ঢেউয়ে ঢেউয়ে আগুন জ্বলে’ এবং ‘নোনা ঢেউয়ে ভিজে ভিজে পুড়ে যাওয়া’র মতো আপাত বৈপরিত্যের সমন্বয় সাধন করার প্রয়াস পেয়েছেনÑ যা একমাত্র রোমান্টিক কবিদের দ্বারাই সম্ভব।
সমাজের একজন সচেতন ব্যক্তি বলে কবির চোখে ধরা পড়ে সমাজের অন্তর-বাইরের প্রকৃত স্বরূপ। আমাদের সমাজে বাহ্যিক চাকচিক্যকে আসল বলে মনে করা হয়। কিন্তু এ ধারণা ভুল। কারণ বাইরের আড়ম্বরতা অন্তসারশূন্য। তাই মানুষ খোঁজে ফেরে নিজের প্রকৃত স্বরূপ। কবিও সেরকম স্বরূপ খোঁজেছেন তার কবিতায়-
“একা মানুষ খটুটিয়ে দেখে স্বরূপ মনঝিলের শালুক
পাঁজরতলায় বাজা উছল স্বর ভাঙে বেদনার প্রকোপ,
আয়নার নয়নও যায়না অথৈ
মনমহলে। বারান্দায় বসিয়ে দেখায় কেবল মুখের বায়োস্কোপ।” Ñআয়নার বায়োস্কোপ
‘জলের শাড়ি’ কবির একটি ভিন্ন স্বাদের কবিতা। এ নাতিদীর্ঘ কবিতায় কবি প্রকাশ করেছেন নদীপ্রশস্তি ও নদীর বদান্যতার আখ্যান। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নদী প্রায় প্রতিটি শিল্পী-সাহিত্যিককে আকৃষ্ট করেছে প্রবলভাবে। এ ক্ষেত্রে কবি রুহুল কাদেরও ব্যতিক্রম নন। তিনি এ কবিতায় দেশের প্রধান-অপ্রধান বারোটি নদী-প্রশস্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন। মধুমতি, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা, ফুলেশ্বেরী, যমুনা, সুরমা, রূপসা, মাতামুহুরী, কুশিয়ারা, কর্ণফুলী ও ডাকাতিয়াÑ প্রভৃতি নদীর অবদান ও সৌন্দর্যবোধ কবিকে করেছে দারুন আচ্ছন্ন। কবি যখন বলেনÑ
“মাতামুহুরী, কুশিয়ারা, কর্ণফুলী
যেনবা জলের দীঘল শাড়ি
যেনবা স্নানোত্থিতা দেশমাতৃকা সলাজে জড়িয়েছে বুকে সম্ভ্রমের কাঁচুলি
তবু একটি নদীর নাম ডাকাতিয়া, ডর নেই স্রোতের সন্ত্রাসে
খরানে বিরান বুক ঠান্ডা জলধারায় লুট হতেও ভালোবাসে।
*** *** *** *** ***
নদীরা মায়ের বিশ্বস্ত ঘ্রাণময় শাড়ি অথবা শত স্রোত
জড়ো হওয়া এক অচেনা জলমোহনা।” – জলের শাড়ি
কবি রুহুল কাদেরের এ কবিতা পাঠে পাঠকের মনের মুকুরে সহসাই ভেসে উঠে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘বলাকা’ কবিতার “সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা/ আঁধারে মলিন হল- যেন খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার”-এর চিত্রপট। অথবা জীবনানন্দ দাশ-এর ‘এই পৃথিবীতে একস্থান আছে’ কবিতার “কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল,/ সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল”-এর মতো লালিত্বমাখা পঙ্ক্তিমালা। পাঠকের অন্তরে বোধের ব্যাপ্তি ঘটানোয় এ ক্ষেত্রে কবি রুহুল কাদের এক অনন্য সাধারণ আসনে সমাসীন হয়েছেন। তাছাড়া অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর নদীকেন্দ্রিক কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র নাম কার না অজানা। এ উপন্যাস দুটি পড়ে পাঠক রসে আপ্লুত হন। অনুরূপভাবে কবির এ কাব্যগ্রন্থ পাঠেও পাঠকহৃদয় কাব্যরসে আপ্লুত হবেন। কবি রুহুল কাদের তার ‘জলের শাড়ি’ কবিতায় যেন বিন্দুর মাঝে সিন্ধুর সমগ্রতা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নগর সভ্যতার এ যুগে নদী খেকো বিধ্বংসী অমানুষগুলোর বিরুদ্ধে-
“নদী মরলে জন্মায় কি আবার তবু নদী মারে দখলদূষণ বাড়ির সতীনে” Ñবলে তীব্র ধিক্কার এ কবি ছাড়া আর কে দিতে পেরেছেন?
প্রন্থভুক্ত উল্লেখযোগ্য ১০টি কবিতার আলোচনা শেষে লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় অন্যান্য কবিতার আলোচনা থেকে নিবৃত্ত রইলাম। তবে এ কাব্যগ্রন্থের সমস্ত কবিতার একটি নির্যাস ক্রমানুসারে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো। ১ম থেকে ৫০টি কবিতাক্রমের আলোকে কবিতাগুলোর মর্মার্থ নিম্নোক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যায়:
১। নোনা ঘ্রাণের মানুষ: নিরপেক্ষ থাকলেও অযাচিত অত্যাচার থামে না।
২। সুই: লেজুড়বৃত্তির পরিহাস।
৩। পার্থক্যের ব্যাকরণ: বয়স বাড়ার প্রভাব, অতীত স্মৃতি রোমন্থন।
৪। আয়নার বায়স্কোপ: মানুষের বাইরের স্বরূপ প্রকাশ পেলেও অভ্যন্তরীণ স্বরূপ থাকে ঢাকা।
৫। অক্ষরের কোলাহল: সময় বহমান কিন্তু স্মৃতিগুলো থাকে অমলীন।
৬। প্রত্নসৌধ: কুমিল্লার ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার, শালবন ও পুরাকীর্তির স্মৃতি বর্ণনা।
৭। মানুষের অসুখ: নৃশংসতার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রæপ প্রকাশ।
৮। সময়ের ফেন: নাগরিক কদর্যতা ও ভদ্রবেশি অসভ্য সমাজের নগ্ন বাখান।
৯। দৃষ্টির ঢেউ: দৃষ্টির গভীরতা ও প্রেমাকুতি।
১০। জলের শাড়ি: নদী প্রশস্তি ও নদীর অবদান স্বীকার।
১১। শস্যের গান: কৃষিভূমির প্রতি ভালোবাসা ও অনার্যের গৌরব।
১২। ধানের লাবণ্য: অনার্য কৃষাণের হৈমন্তিক প্রশস্তি।
১৩। জন্মদাগ: উপেক্ষিত ব্রাত্যজনের প্রতি সহানুভূতি ও মমতা প্রকাশ।
১৪। স্বপ্ননিয়ন্ত্রণ: মানুষের স্বপ্নকে নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা।
১৫। ভূগোলপাঠ: অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা ক্রোধ ও ক্ষোভ দুটিই বাড়ায়।
১৬। মুখোশ: নকল ও কৃত্রিম সবকিছ ুঅস্থায়ী, কিন্তু খাঁটিত্বের অস্তিত্ব চিরকালব্যাপী।
১৭। অশ্র”র আসর: প্রিয়জনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে স্বগত ভাবনা।
১৮। নীলমাছ: দুঃখ জর্জরিত মানুষের কাছে অন্যের দুঃখের বয়ান বড্ড তুচ্ছ বলে মনে হয়।
১৯। জুতা ও বেদনাষিয়ক: শক্তিমান সবসময় শক্তিমানই থাকে, অবশেষে পরাজিত হয় সাময়িক দাম্ভিক শক্তিমত্তা।
২০। উড়ে ইকারুস: অবাধ স্বাধীনতা ভালো নয়, তবু স্বাধীনতাই একমাত্র কাম্য বিষয়।
২১। বেমানান নৃত্যমঞ্চে: মিথ্যার প্রহারে সত্যকে পরাজিত করা যায় না।
২২। জলকেলি: মায়া ও ছলনা যতই কাছে ডাকুক, তবু ভয় নেই।
২৩। পিপাসার উৎসব: ভালোবাসা বঞ্চিত দহনের ¯্রােত।
২৪। একটি ছবি: সামাজিক কদর্যতা ও নগ্নতা থেকে বাঁচার আকুতি।
২৫। জলঅনলের জীবন: অন্তর্দহনে জ্বলা জীবনের বাখান।
২৬-৩০। আলো-আঁধার, অনর্থ, ইতিহাস, ওমঘর, কালো অক্ষর: যাপন জীবনের উপলব্ধি প্রকাশ।
৩১। কবিতা দ্রৌপদীর বোন: কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রশান্তি বর্ণনা।
৩২। জোছনারোদে অগ্নিস্নান: শান্তিপ্রিয় মন অসুন্দরের ঐন্দ্রজালিকতায় বিব্রতবোধে জর্জরিত।
৩৩। মুহূর্তের চোখ: বৃষ্টিদিনে ভালোবাসার পাঁচালী।
৩৪। হাওয়াগুহা: ধু¤্রজাল, ছায়া ও আলো-আঁধারী খেলা অন্তরে দিবাস্বপ্নের বিভ্রম জাগায়।
৩৫। কাঠের গল্প: দুর্যোগে ভদ্রের পতনে ইতরের আস্ফালন।
৩৬। চকমকির ঠোঁট: নগরের পতিত লোলুপতায় নাগরের বটুদের বাখান।
৩৭। একরাত্রি ঘুমের জন্য: দুঃখ ও যন্ত্রণাবোধের কালযাপন।
৩৮। ঘাসফুলের রূপে: মিথ্যা বাহুল্যের আহŸানে অকৃত্রিম প্রণয়ের আশ্বাস।
৩৯। সেলাইশিল্পের সুদিনে: মিথ্যার খরস্রোতে সত্যের অবদমন প্রচেষ্টার দাম্ভিকতা।
৪০। কলের শকুন: নগর সভ্যতার উন্নয়নে নিসর্গের মৃত্যুযাত্রা।
৪১। কবি: নৈঃশব্দের পাথারে কবিসত্তার শিকারী সাঁতার।
৪২। লুই পাস্তরের প্রতি: অপশক্তির দংশনে জর্জরিত কবিসত্তার আত্মবিলাপ।
৪৩। গল্প ঃ এক, দুই: অপবাদের তাপে শেষ বিশ্বাসটুকু উবে যায় নিশাদলের মতো।
৪৪। জলের সিন্দুক: সমুদ্রসঙ্গমে সাগরজলের সৃজন বন্দনা।
৪৫। গ্রামগোধূলি: শৈশব স্মৃতি, বাৎসল্য ও নস্টালজিয়ার বাক্সময় প্রকাশ।
৪৬। স্নেহভেজা আঙুল: পিতৃ অবলম্বন হারানোর তাপিত শোক।
৪৭। আকুল মাছরাঙা: বহমান সময়ে রূপযৌবন ক্ষয়ের তাপিত কথন।
৪৮। আমার ঘর: স্বদেশ, স্বভূমি ও স্বজাতির প্রতি আন্তরিক টান; সহজ-সরল অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহী প্রাণ।
৪৯। স্বর্গপুরাণ: বাংলার অতীত প্রত্ন-ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহসিকতার আধুনিক বয়ান।
৫০। মাটিয়াল: নিষ্ঠাবান সৃষ্টিশীল কর্মী পতিত জমিতে গড়ে তোলেন শিল্পসৌধ। বি ংযবষষ ড়াবৎপড়সব- আমরা করবো জয়।
এ কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় ফ্ল্যাপ থেকে কবির সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি জানা যায়। কবি রুহুল কাদের কুড়ি শতকের প্রান্তিক নব্বই দশকে প্রকাশিত ব্যতিক্রম স্বর। কবিতায় নিমগ্ন তিনি, গল্প এবং মননশীল প্রবন্ধের জমিনেও সমান দক্ষতায় বিচরণশীল। সমকালিক স্বপ্ন, বেদনার দহন মন্থন করে মানবিক জীবন, মন ও মননজ সাম্রাজ্যের চিরায়ত রূপধ্যানী কারুকৃৎ তিনি। ভাষা আর গহন বোধের নন্দনবন্ধনে তাঁর সৃষ্টি স্বকীয় ব্যক্তিতায় উজ্জ্বল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বিএ [অনার্স] এমএ ডিগ্রি লাভের পর ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জড়িত আছেন সাতকানিয়া আদর্শ মহিলা কলেজে অধ্যাপনা পেশায়। রুহুল কাদেরের জন্ম কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাস্থ বরইতলীর পহরচাঁদা গ্রামে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ। বাবা [মরহুম] সৈয়দ আহমদ বাহাদুর, মা সাদেকা বেগম। রুহুল কাদেরের প্রকাশিত অন্যান্য বই : ১. মন বদলের স্বপ্ন গল্প-২০০৪], ২. দহনদ্রোহ [গল্প-২০১৫], ২. মাতাল মৌয়াল [কাব্য-২০০৯]। ‘মাতাল মৌয়াল’ কাব্যের জন্য লাভ করেন ‘মূল্যায়ন সাহিত্য সম্মাননা-২০০১।’
পাঠকের কাছে কবি একটি সুন্দর কাব্য উপহার দেয়ায় তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কামনা করি এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যেন মহাকালে স্থান করে নেন পাকাপোক্তভাবে। কবির প্রতি রইলো নিরন্তর শুভেচ্ছা এবং ‘শেলাইশিল্পের সুদিনে’ কাব্যগ্রন্থটি যেন পাঠকের মনের দুয়ার খুলে দেয় সে কামনাই রইলো।