অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আল্লামা জালাল উদ্দিন আল-কাদেরী (রহ.)

533

আবু সাঈদ মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন: আল-কাদেরী, খতীবে বাঙাল হিসাবে পরিচিত। জম্ম : ২৯ জুলাই ১৯৪৪খ্রি., চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার চরকানাই গ্রামে । পিতা : হাজী অলি আহমদ। মাতা : হাজী সুফিয়া খাতুন। স্ত্রী : খুরশিদ জাহান চৌধুরী। শিক্ষা অর্জন: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, দারুল উলুম আলিয়া, সাতকানিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম এবং ছারছিনা দারুস সুন্নাহ আলিয়া, বরিশাল। ঐতিহাসিক বর্ণাট্য জীবনে প্রাপ্তি ও প্রদান : পবিত্র কোরআনুল করীমে আল্লাহ পাক রাব্বুল আ’লামিন ইরশাদ করেন- ‘ওয়ামা আলায়না ইল্লাল বালাগ’ অর্থাৎ- আমাদের উপর আল্লাহর বাণি পৌঁছিয়ে দেওয়াই একমাত্র দায়িত্ব।

আর হাদিসে পাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘বাল্লিগু আন্নি ওয়ালাউ কা’না আয়াতান’ অর্থাৎ- আমি রাসূলের পক্ষ থেকে একটি হলেও আমার বাণী (হাদিস) তোমরা পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছিয়ে দাও। ইসলামের এ মহা মূল্যবান কোরআনের আয়াত ও হাদিস শরীফ-এর মর্মবাণীতে উজ্জীবিত হয়ে ইসলাম প্রচারক বার আউলিয়া তথা সুফিয়ায়ে কেরামদের দায়িত্ব-আদর্শ মনে-প্রাণে লালন করে সারা দুনিয়ায় ইসলামের সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা ও প্রচার-প্রসারের লক্ষে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন আল্লামা জালাল উদ্দিন আলকাদেরী। তিনি ছিলেন কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও আকায়েদ-তাসাউফ শাস্ত্রের অগাধ ইলম-এর অধিকারী এক মহান ব্যক্তিত্ব যার ইলমের উত্তরাধিকালী হয়েছেন, বুযুর্গ ও হাজার হাজার আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস ও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন পদস্থ ব্যক্তির ওস্তাদ (শিক্ষক)। তিনি শুধু জাহেরি ইলমে দ্বীন হাসিল ও প্রচার-প্রসারে নিজেকেব নিবেদন করেননি, বরং অন্তরে লুফে নিয়েছিলেন দরবারে সিরিকোটির গুপ্তধনকে (তরীকতকে)। নির্ভেজাল শরীয়ত-তরীকত প্রচার-এ আত্মত্যাগে নিজেকে মনোনিবেশ করেন। সেইসাথে সহপাঠি,সহকর্মী, ছাত্র-শিক্ষক ও সমাজসহ আম-জনতা এবং পরিবারের সদস্যদেরকেও মনোনিবেশ করান এ মহান সিলসিলায়। এরবাইরে তিনি দেশের বরহক সকল দরবার এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাভাজন ছিলেন। মহানবীর আদর্শকে ধারণ করে ছোট বেলায় (৬০ এর দশকে) ভগ্নিপতি হযরত মাওলানা আজিজুর রহমানের সাথে বিশ্বখ্যাত শায়খে তরীকত আল্লামা হযরত সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.) হুজুরের কাছে এসে দোয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জামেয়ায়। ৭০ এর দশকে হেদায়েতের ঈমানি দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্বীয় পীর ও মুর্শিদ গাউসে যমান আল্লামা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ) হুজুরের কাছে। শিক্ষকতায়, খেতাবতে, মাঠে-ময়দানে ওয়াজ-নসিহতে ও তরীকতের খেদমত আন্জামে দায়িত্ববোধ,কর্তব্যপরায়নতা ও নিষ্ঠায় স্বীয় পীর ও মুর্শেদের নেক নজরে ধন্য হন। ১৯৮৭ সাল থেকে তাঁর ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বর্তমান হুজুর কেবলা গাউসে যমান আল্লামা হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ (ম.জি.আ) হুজুরের সান্নিধ্যে ছিলেন।
কর্ম : আল্লামা জালাল উদ্দিন আলকাদেরী ৭ জুন ১৯৭১ থেকে ৩০ এপ্রিল ১৯৮০ খ্রি. মুহাদ্দিস ্এবং ১মে ১৯৮০ খেকে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩ খ্রি. অধ্যক্ষ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন, চট্টগ্রাম । এছাড়া তিনি হামিদুল্লাহ খান জামে মসজিদ, খাতুনগন্জ (১৯৮৭ পূর্ব পর্যন্ত) ও জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ, চট্টগ্রাম (১৯৮৭-২০১৬ খ্রি :)- দায়িত্ব পালন করেন। একজন সাংবাদিক হিসাবেও তাঁর অনন্য ভূমিকা মুসলিম মিল্লাতের কিদমতে রয়েছে। তিনি মাসিক তরজুমান (প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ খ্রি 🙂 সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিদেশ সফর : সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার, মালয়েশীয়া, মিশর, কাতার, বাহরাইন, আমিরাত, কুয়েত, ইরাক, ওমান, যুক্তরাষ্ট্র , যুক্তরাজ্যসহ অসংখ্যদেশ। লেখক : দরসে কোরআন (অধম আব্বাস এর ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে সংস্করণে বখতিয়ার হুজুরের সাথে সহযোগিতা করার সৌভাগ্য অর্জন হয়) ও লেখক-অনুবাদক : তাফসীরে রুহুল কুরআন। চেয়ারম্যান : শরীয়াহ বোর্ড, আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। আহবানে : আন্তর্জাতিক শাহাদাতে কারবালা মাহফিল পরিচালনা পর্ষদ (১৯৮৭-২০১৬ খ্রি :)। সহ-সভাপতি : জমিয়তুল মোদাররেসীর কেন্দ্রীয় পরিষদ (আমৃত্যু)। বের্ডস অব গভর্নর : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (২০১৪-২০১৬ খ্রি :)। সদস্য : বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা (২০০৮ খ্রি :)। আহবায়ক, জাতীয় খতীব কাউন্সিল বাংলাদেশ (২০১০ খ্রি :)। সম্মাননা: ১.শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ (জাতীয় পর্যায়ে) প্রধানমন্ত্রীর পদক ২০০১ খ্রি :। ২. শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ (জাতীয় পর্যায়ে) রাষ্ট্রপতির পদক ২০০৪ খ্রি .। লেখকদের প্রেরণাকারী : হুজুর যেহেতু মাসিক তরজুমান এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৩ খ্রি : পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন, এ সময়ে যারাই তরজুমানে লিখে লেখক হয়েছেন তাদেরকে তিনি লেখা-লেখির দারুষ উৎসাহ প্রদান করতেন। আমি ১ম তরজুমানে নিয়মিত লেখা শুরু করি ২০০০ সালে (কামিল হাদিস ১ম বর্ষে ‘জনপ্রিয় বই ‘কবরের প্রথম রাত’দিয়ে। তবে এর আগে যদিও লেখা প্রকাশ হয় দৈনিক আজাদী/ জাতীয় দৈনিক মানবজমীন/যায়যায়দিন পত্রিকায় )। এছাড়াও ২০১১খ্রি : সালে আমার রচিত ৪৬৮পৃষ্ঠার ‘দুরুদ শরীফের বাস্তব কাহিনী, বইটি হুজুরের কাছে জামেয়ার মুহাদ্দিস আবুল আসাদ মুহাম্মদ জুবাইর রজভী মারফত সৌজন্যকপি পাঠালে, অধ্যক্ষ হুজুর মাথায় দু’হাত উঁচু করে দোয়ায় বলছিলেন ; আমার আব্বাস-তো আশেকে রাসূলের জন্য বড় উপাদান উপহার দিয়েছে। হুজুরের প্রেরনা আজ আমাকে ‘‘তিবয়ানুল কোরআন’’,বোখারী শরীফের অনু ; ‘নিয়ামুল বারী’, ‘জামেউল আহাদিস’, ‘ফতওয়ায়ে রেজভীয়া’ খন্ড-৯সহ প্রায় ১০০টি বই ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষনা ম্যাগাজিন/পত্রিকায় দেড় শতাদিক প্রবন্ধ রচনার সুযোগ করে দেন। ১০০ বইসহ ই.ফা.বা, ঢাকার কোরআনের তাফসীর বিশ্বকোষ পর্যন্ত পৌঁছান। এককথায় যে কাউকে ভালকাজের স্বীকৃতি দিতেন।
গুণিজনের মন্তব্য : সাবেক ভি.সি প্রফেসর ড. ইফতিখার উদ্দিন চৌধুরী (চবি) বলেন-‘তিনি বিশ্ববরেণ্য আলিমে দ্বীন, আহলে সুন্নত জামা’আত এর অবিসংবাদিত মুবাল্লিগ। হ্রদয়স্পর্শী বয়ান ও বাগ্মিতা শ্রোতাদের আকর্ষণ করত। আমি হজ্বে শরীক ছিলাম মিনা ও আরফার ময়দানে জালাল হুজুরের মর্মস্পর্শী মোনাজাতে আমরা অঝর নয়নে কাঁদছিলাম। তাই জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে নামাজ আদায় করতাম। (জীবন ও দর্শন,পৃ.১৪) । ভি.সি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আহসান সাইয়েদ (ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা) বলেন- তিনি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা,এ দেশের সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণে জমিয়তুল মোদাররিছিনের আন্দোলনের মাধ্যমে যে অবদান রেখেছেন. তা চিরস্মরণীয়। (জীবন ও দর্শন,পৃ.১৫)। চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক শামসুল আরেফিন বলেন- জালাল হুজুরের ইলম অতুলনীয়। তার সান্নিধ্য আমাকে অনুপ্রেরিত করেছে। ((জীবন ও দর্শন,পৃ.১৭)। সাবেক জজ ও ই.ফা.বা মহা-পরিচালক শামীম আফজল বলেন- হুসনে সুলুকের জন্য সব মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিলো ঈর্ষণীয়। ((জীবন ও দর্শন,পৃ.১৮)। দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন বলেন- ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণে,উন্নয়নে-সম্প্রাসারণে,বৈষম্য দূরীকরণে জমিয়তুল মোদাররিছিনের আন্দোলনের আমার পিতা মরহুম আলহাজ্ব এম এ মান্নান রহ. এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তা জমিয়তের ইতিহাসে চির স্মরণীয়। (জীবন ও দর্শন,পৃ.২০)। দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন- আমার পিতা মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব আব্দুল খালেক (রহ.) ছিলেন কাদেরিয়া তরিকতের প্রসিদ্ধ ধারক হযরত শাহসূফী আল্লামা সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ)’র বিশিষ্ট মুরিদ। তার ১ম খানকাহ ছিল আমাদের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের উপরতলা। ছোটবেলা থেকে জামেয়ায় আসতাম। জালাল হুজুরের ইলম ও বয়ানের মর্যাদা অতুলনীয়। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। (জীবন ও দর্শন,পৃ.২১)। তাকে নিয়ে অনেকে লিখেছেন। আল্লামা আবুল কাশেম নূরী, পীর আল্লামা আহসানুজ্জামান ও পীর নঈমুল কুদ্দুস আকবরী বলেন- জালাল হুজুরের মর্যাদা তুলনাহীন। ইন্তেকাল : ২৫ সফর’ ১৪৩৮ হিজরি মোতাবেক ২৬ নভেম্বর’২০১৬ খ্রি . ঢাকা ২টি (কাদেরীয়া তৈয়বিয়া আলিয়া/ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ.কর্মস্থল ) ও চট্টগ্রামে ২টি(জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া/ জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ.কর্মস্থল ), মোট ৪টি জানাযা হয়। মাযার : জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়াসংলগ্ন নিজস্ব কবরস্থানে। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক।
লেখক : প্রাবন্ধিক