অনন্য বিব্রতবোধ

49

মনসুর নাদিম

সারা বিশ্ব মহামারীতে অস্থির। সোয়ান ফ্ল্ , বার্ড ফ্লু’র পরে এখন শুরু হয়েছে ‘করোনা’। সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদিনা শরিফে প্রথমে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়, পরে কিছুদিন নির্ধারিত সময়ে খোলা রেখে আবারও গত শুক্রবার থেকে কার্ফ্যু জারি করেছে সৌদি সরকার। করোনাভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য এ ব্যবস্থা বলা হলেও বিশ্ব মুসলিম এতে সন্তুষ্ট বলে মনে হয় না। এলেখা যখন লিখছি তখন বাংলাদেশের মসজিদ গুলি অন্য সময়ের তুলনায় মুসল্লি উপছে পড়ছে। বাংলাদেশে সতর্কতা অবলম্বন করে মুজিববর্ষের, স্বাধীনতা দিবসের সকল অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে গণজমায়েতসহ নানা ধরনের মিটিং মিছিল। স্থগিত করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারি-বেসরকারি অফিস, কারখানা গুলো ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন থেকে দুই দফায় প্রজ্ঞাপন জারি করে ১১ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। মানুষজনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে (ঘরবন্দি) থাকতে বলা হয়েছে। রাস্তাঘাটে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনী নামানো হয়েছে। অবাধ্য মানুষদের বুঝিয়ে, প্রয়োজনে পিটিয়ে ঘরমুখো করা হচ্ছে, এনিয়ে কোন কোন জায়গায় বাড়াবাড়ি হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ সমালোচিত হতে দেখা যায়। মানুষ এক আতংকের মধ্যে সময় পার করছে। বরাবরের মত সংকটকালে কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে । একদিকে মজুদদারি মুনাফাখোরীর দল, অন্যদিকে কবিরাজ, বৈদ্যদের করোনার ঔষধ আবিষ্কার ও চমকপ্রদ ধান্ধাবাজিতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। ইউটিউবে করোনা থেকে নিষ্কৃতি পেতে যেমন নানা রকমের দোয়া পাওয়া যাচ্ছে ঠিক তেমনি নানা তন্ত্র-মন্ত্র ও নিয়ম-কানুন পাওয়া যাচ্ছে। তবে একটা পজেটিভ তথা প্রশংসনীয় দিক হল, এইদেশে আপদকালীন সময়ে সামান্য সংখ্যক মীরজাফর ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হতে অতীতেও দেখা গেছে। এখনো দেখা যায়। ৭০’র বন্যা, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯১’র ঘুর্ণিঝড় আজকের মহামারী ‘করোনায়’ সবসময় দেখা গেছে তারুণ্যের ঝাঁক দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সংকট মোকাবেলায়। এই মহামারী থেকে রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের অনেকে দিন-রাত দোয়া দরূদ পড়ছেন। সর্বত্র এই করোনা’র আলোচনা। গুজবও কিন্তু কম নয়। ইউটিউব, ফেসবুকে গুজব ছড়ানো লোকের অভাব নেই। একশ্রেনীর লোকের স্বভাব সবকিছুতে রাজনীতির গন্ধ খোঁজা। সারাবিশ্ব এই সংকট মোকাবেলায় যেখানে হিমসিম খাচ্ছে সেখানে আমরা এত সহজে ফুঁ দিয়ে সংকট দূর করে দেব তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। অনেকে জাস্টিন ট্রুডোর প্রসঙ্গ টানেন। জাস্টিন ট্রুডোর দেশের আয়তন, জনসংখ্যা ও অর্থনীতি আর আমাদের দেশের আয়তন, জনসংখ্যা ও অর্থনীতি কী এক ? জাস্টিন ট্রুডোর সাধ ও সাধ্য দুটোই আছে পক্ষান্তরে আমাদের সাধ ও সাধ্যের মাঝে বিস্তর ব্যবধান। জাস্টিন ট্রুডোর দেশের লোকেরা তাঁকে সহায়তা করছে। ফেসবুকে দেখলাম আমাদের অনেক মুরুব্বি মাস্ক পরা থেকে বিরত রয়েছেন ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেকে পাক্কা ঈমানদার দাবি করে। অথচ ধর্মে আত্মরক্ষা, সাবধানতা অবলম্বনের ব্যপারে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহামারী সম্বন্ধে হাদিসটা তো এখন সবার মুখে মুখে। তাই আমি আর এই আলোচনা করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাইনা। শুধু বলবো, আল্লাহ যেন এই গজব মহামারি থেকে আমাদের হেফাজত করেন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যপার হল, শতকরা ৯৮% মানুষ এখন করোনা এক্সপার্ট। এখানে করোনা’র ভয় আছে বলে আমার মনে হয়না। আর মাশাহআল্লাহ হুজুরেরা তো আছেন। ইসলাম একটি পুর্নাঙ্গ জীবন বিধান। তাই মহামারীতে করণীয় কী তাও ইসলাম বলে গেছে। কোরআন এবং হাদিসে নেই এমন কিছু কেউ দেখাতে পারবেনা। যারা কোরআন/হাদিস অধ্যায়ন করেননা তারা এসব বিষয়ে জানার কথা না। মজার ব্যপার হচ্ছে কিছু লোক না জেনেই বিদ্রæপের তীর ছুড়ে পাÐিত্ব ফলাতে চায়। আসলে এরা কুয়োর ব্যাঙ। তবে দুঃখটা হচ্ছে, আলেম-ওলামা বা মুসলিম ধর্মীয় পÐিতরা দোয়া-দরুদের কথা আমাদের বলছেন, কিন্তু এ ধনণের মহামারির প্রতিষেধক তৈরিতে মুসলমানরা কোন গবেষণা করছেন কিনা আমাদের জানা নেই। অথচ নবী করিম (দ.) এর যুগ থেকে ১৭শ খ্রি. পর্যন্ত ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের ব্যাপক অবদানের কথা। যাক, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। কয়েকবছর পর পর একেকটা শ্লোক বের হয় চট্টগ্রামে যেমন একদা বের হয়েছিল- ‘পোষানি চওন’ ‘মার বদি আলম’ তারপর বের হল-‘ কেনে চলর’ এরপর বের হল ‘ আঁই কিত্ত্যাম’ । মাঝখানে আরও কয়েকটা বাক্য মুখে মুখে প্রচার হলেও জনপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণে হারিয়ে গেছে অথবা নতুন বাক্যের আবির্ভাবে পুরোনোটার তিরোধান। দেশে তো আছেই, প্রবাসীরা এগুলো খুব এঞ্জয় করে বিশেষ করে আমাদের রেমিটেন্স সৈনিক মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী শ্রমিকেরা।
আবুধাবি বদলি হয়ে যখন প্রথম একটি ব্যাচেলর রুমে উঠেছিলাম সেখানে এক মাঝ বয়স্ক লোক থাকতেন আগে থেকেই। তাই তার সাথে তেমন কথা-বার্তা ছিলনা আমার। কিছু মানুষ আছে সারাক্ষণ চেহেরাটা রাগে ব্যাঙের মত ফুলিয়ে রাখেন। তিনিও এরকম চেহেরা নিয়ে ঘুরতেন সারাক্ষণ।প্রবাসে যারা অভিজ্ঞ তারা চেহেরা দেখেই বলে দিতে পারেন কোন লোক কোন দেশি ? বাঙালিদের বেশিরভাগ রাগী রাগী চেহেরা। জানিনা কোন জনমের এই রাগ অন্তরে পুষে রাখছে। আমাদের রুমের তরুণ ছেলেরা ঐ বয়স্ক লোকটার সাথে সারাক্ষণই হাসি ঠাট্টা করে থাকে। এক উইকেন্ডে ডিনারের পর বাতি নিভিয়ে যার যার বিছানায় শুয়ে গল্প করছিলাম আর হাসাহাসি হচ্ছিল দারুণ। একজনের কথায় আমারও কেন যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল-‘ মার বদি আলম’। মুহ‚র্তে পিন পতন নীরবতা। অন্ধকার রুমে তখন যেন আমি একা। নিঃশব্দ ভুতুড়ে আঁধারে কিংকর্তব্য বিমুঢ় । আমার পাশের বেডে ছিলেন বন্ধু হাজী সাহেব। ফিসফিস করে বললাম-ব্যপার কী ? ভুল কিছু বললাম নাকি ? হাজি সাহেব চাপা হেসে ফিসফিসিয়ে বললেন- ঐ বেটার শ্বশুরের নাম বদিউল আলম। কেউ মার বদি আলম বললে ও ক্ষেপে যায়। যদিও এই কথাটা তার শ্বশুর সম্পর্কীয় নয়। ঘটনা বুঝতে পেরে হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারলামনা। তবে এটা বোঝা গেল তিনি আমাকে শ্রদ্ধা করেন বিধায় নীরবে ধুঁয়া গিলেছেন। কিছুক্ষণ পর ফিসফিস ফুসফুস থেকে আবারও মৃদু চাপা গুঞ্জন, চাপা হাসি। আমি আর হাজি সাহেব এবং বয়স্ক লোকটা আর একটি কথাও না বলে নেত্রপলক একত্রে করার চেষ্টা করলাম। ২০১৫তে যখন একেবারে দেশে এসে গেলাম তখন রাস্তাঘাটে শুনতে পেলাম নতুন একটি বাক্য- ‘কেনে চলর’(কেমনে চলতেছ)। আমার বিল্ডিঙে এক নতুন ভাড়াটিয়া এলো। তার ৪/৫ বছর বয়সী একছেলে। চেহেরা ও গায়ের রঙ আফ্রিকানদের মত হলেও কথা-বার্তায় বেশ টনটনে। আমাকে দেখলেই নানা, নানা বলে চিৎকার করে থাকে। একদিন আমাকে দেখেই বলল- নানা, কেনে চলর, কী খায় বলর, আঁর খবর ক্যা ন’লর (নানা, কেমনে চলতেছেন, কী খেয়ে মতা-তাজা হচ্ছেন, আমার খবর কেন নিচ্ছেননা)। এতটুক ছেলের মুখে এহেন বাক্য শুনে আমি বিস্মিত। এটা বলে সে আর দাঁড়ায়নি এক দৌড়ে উপরে উঠে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম আর হাসতে লাগলাম, আমরা অতটুকুন বয়সে মায়ের আঁচলের নীচ থেকে বেরই হতাম না।
এ ঘটনার অনেকদিন পর আরেকটা কথা শুনলাম-‘আঁই কিত্তাম’ (আমি কী করতাম)। কথায় কথায় একজন আরেকজনকে বলে, ‘আঁই কিত্তাম’। চট্টগ্রামের ইতিহাস পাঠে জানা যায় এতদঅঞ্চলের লোকেরা অধিকাংশ রসিক। যখন বিনোদনের জন্য কোন মাধ্যম কিংবা প্রযুক্তি ছিলনা তখন এখানের মানুষ জোছনা রাতে পুঁথি পাঠ, জারিগান, সারিগান করতেন। হেমন্তের শেষে ঘরে ঘরে ফসল তোলার পর খালি ফসলি জমি গুলিতে হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা ইত্যাদি খেলা করতে দেখা যেত। কথায় কথায় ছন্দ মেলাতো। ছন্দ মিলিয়ে কথা বলা অনেকের নিকট ফ্যাশন ছিল। আজকাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আগ্রাসনে সমাজের প্রাকৃতিক আনন্দের নদীতে চর জেগেছে। মানুষের পোশাক পরিচ্ছদে, খাদ্যাভ্যাসে আমুল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষিতের হার বেড়েছে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বর্তমান প্রজন্মের লাইফ স্টাইল চেঞ্জ হয়ে গেছে। মিল কারখানার ধুঁয়া ও বৈর্জ্যে পরিবেশ দূষণ হয়েছে ফলে পৃথিবীতে নানা দুরারোগ্য ব্যাধির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে রোগ ও ছিলনা কোন ডিগ্রীধারী ডাক্তারও ছিলনা। এখন প্রচুর ডিগ্রীধারী ডাক্তার আর সাথে অদ্ভুত অশ্রুতিপুর্ব রোগ সকল। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাজত করুন।
লেখক : কলামিস্টমনসুর নাদিম