অদৃশ্য ঘাতক বায়ুদূষণ

63

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ভারত ও চীনের পরে বাংলাদেশের অবস্থান। অন্যদিকে বড় শহরগুলো মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে বিশ্বে রাজধানী ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। বায়ুদূষণের এ আগ্রাসন থেকে পিছিয়ে নেই খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোও। শিল্পবজ্যের কারণে শহরগুলোয় বায়ুদূষণ বাড়ছে ক্রমাগত। শিল্পাঞ্চলের আশপাশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী মারাত্মক আক্রান্ত হচ্ছে সব রোগে। প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে জাতিসংঘ। এবছর পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘এয়ার পলিউশন বা বায়ুদূষণ’ এবং দিবসের স্লোগান বিট এয়ার পলিউশন আসুন, বায়ুদূষণ রোধ করি’।
আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ও এয়ার ভিজ্যুয়াল গবেষণা জরিপ বলছে, ২০১৮ সালের দূষণের সূচকে বিশ্বের তিন হাজার ৯৫টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের ২২টি ভারতের, পাকিস্তানের দু’টি, চীনের পাঁচটি ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর রয়েছে। দূষণে শীর্ষ ৩০-এ ঢাকার অবস্থান ১৭তম।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নাগরিক ভোগান্তি। এসব ভোগান্তির অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ, যা আমাদের জীবনকে করে তুলছে অসহনীয়। ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও আমাদের কিছু সচেতনতা ও কার্যকরী পদক্ষেপ তা অনেক কমিয়ে আনতে পারে। কার্যকরী ও জনসচেতনতা না বাড়ালে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ।
নীরব ঘাতক এ বায়ুদূষণের ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন তা এখন ভাবার সময় এসেছে।
বায়ুদূষণের ফলে শুধু ফুসফুসকেন্দ্রিক রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে এমনটি নয়। এর মাধ্যমে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি অনেক ছোটখাট রোগবালাই, যেমন- প্রাপ্ত য়স্কদের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার মতো রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে।
এখনই বায়ুদূষণের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে শ্বাসজনিত নানা রোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার ও জিনেটিক পরিবির্তনজনিত নানা অজানা রোগে ভুগতে হতে পারে চরমভাবে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাবে তেমনিভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনশীতাও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে।
শহরে বায়ুদূষণের প্রধান দু’টি উপাদান হলো শিল্পকারখানা ও যানবাহন। বায়ুদূষণের উপাদানগুলো মূলত ধূলিকণা, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সীসা ও অ্যামোনিয়া। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা স্থাপনে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপক হারে নিঃসরণ ঘটছে। যাদের বেশিরভাগই দরিদ্র জনগোষ্ঠী তারা সীসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে (আইকিউ) ও স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে এবং গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে। পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে ২ লাখ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এ থেকে ক্যানসার হতে পারে, যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ইটভাটা থেকে নাইট্রোজেন, অক্সাইড ও সালফার-ডাই অক্সাইড অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি সমস্যা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। বালুকণার মাধ্যমে ফুসফুসের সিøকোসিস নামে রোগ সৃষ্টি হয়, যা ফুসফুসকে শক্ত করে দেয়। কার্বন-মনো-অক্সাইড রক্তের সঙ্গে মিশে অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। সর্বোপরি বহু মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে পড়ে এই বায়ুদূষণ।
অভ্যন্তরীণ কক্ষের অর্থাৎ সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ুদূষণের পরিমাণ বহিরঙ্গের বায়ুদূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক দৈনিক প্রায় ২ লাখ লিটার শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন। যদিও সচেতন জনগণ খাবার পানির জন্য অর্থব্যয় করেন কিন্তু পরিশুদ্ধ বাতাসের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে ঠান্ডা বাতাস পান, কিন্তু পরিশুদ্ধ ঠান্ডা বাতাসের পরিবর্তে অধিকতর দূষিত ঠান্ডা বাতাস গ্রহণ করেন।
বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটরের ব্যাপক ব্যবহার থেকে নির্গত ধোঁয়া, হাসপাতাল ও অন্যান্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নীতি না জানা, সঠিকভাবে ডাস্টবিন ব্যবহার না করা বায়ুদূষণের কারণ। এছাড়া পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি মাল বহন করলে সে যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়। যা বায়ুদূষণ করে। এখনো রাস্তাঘাটে আইন করা সত্ত্বেও ধূমপান ব্যাপকভাবে বন্ধ হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, রাজধানীসহ দেশের সামগ্রিক বায়ুদূষণের ৫৬ শতাংশের উৎস ইটভাটা। ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে সরকার ২০১৮ সালে ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করেছে। নতুন ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সবক’টি ইটভাটাকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করার কথা।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ইটভাটাগুলো কৃষিজমিতে স্থাপন করা যাবে না, কৃষিজমি থেকে মাটি তুলে ইট বানানো যাবে না। এছাড়া জনবসতি, বাজার ও অর্থনৈতিক তৎপরতা আছে এমন এলাকায় ইট ভাটা রাখা যাবে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, ৯৮ শতাংশ ইটভাটা নতুন আইন অনুযায়ী অবৈধ। অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০% দূষণ কমানো সম্ভব। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধকরণ, রাস্তা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ, পানি ছিঁটানো, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি ছিঁটানো ও নির্মাণ সামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃতকরণ, কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা গেলেও কমে যাবে বায়ুদূষণ।
জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। দেশের পরিবেশ রক্ষায় আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে। তাদের সেই কার্যক্রমকে বাস্তবায়ন করতে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সবাইকে মেনে চলা উচিত।
সর্বোপরি বায়ুদূষণ প্রতিরোধে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। জনগণকে বায়ুদূষণের সামগ্রিক বিষয়ে তথ্য দেওয়া, শিক্ষিতকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণ অত্যন্ত জরুরি। বায়ুদূষণের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে এ সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।