অঝোর ধারায় চেনারূপে বর্ষা

95

ক্যালেন্ডারের পাতায় আষাঢ়ের যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগেই টেকনাফ উপকূল দিয়ে মৌসুমী বায়ু প্রবেশ ও দেশজুড়ে বিস্তার লাভ করলেও প্রথম পক্ষে তাপদাহ আর খন্ড-বৃষ্টিরই দেখা মিলেছিল। মধ্য আষাঢ়ে উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপ মিলিয়ে যেতেই দেশজুড়ে সক্রিয় মৌসুমী বায়ু আপন মহিমায় দাপট দেখাতে শুরু করে। আর তাতেই গত পয়লা জুলাই সীমান্তবর্তী কক্সবাজার অঞ্চলের টেকনাফে মৌসুমের সর্বোচ্চ একশ’ ৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের মধ্য দিয়ে চেনারূপে ধরা দেয় এবারের বর্ষা।
ধরায় অঝোরে নেমে আসা বৃষ্টিধারা পরিমাণের দিক থেকে শতকের ঘর ছাড়ানোর সেই ধারাবাহিকতা গতকাল রবিবারও অব্যাহত ছিল। বর্ষা চেনারূপে ধরা দেয়ার পর গতকাল দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতও রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা সীতাকুন্ডে। আর দেশের সর্বোচ্চ একশ’ ৫৪ মিলিমিটার বরিশাল উপকূলের খেপুপাড়ায়। আজ সোমবারও চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ধসের সতর্কতা জারি রয়েছে। চট্টগ্রাম, মংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
এদিকে টানা ভারী বৃষ্টিতে নগরীর নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে এবার তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। দ্রুতই পানি নেমে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, লঘুচাপ কেটে যাওয়ার পর আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহের শুরুতে সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর এই দাপট অব্যাহত থাকতে পারে সপ্তাহজুড়ে। তার মানে, বৃষ্টিহীনতার পাশাপাশি তাপদাহের অস্বস্তি নিয়ে অচেনা রূপে যাত্রা শুরু করলেও বর্ষণমুখরতায় চেনা রূপেই বিদায় নেবে আষাঢ়। চলতি বর্ষা মৌসুমের শেষ মাস শ্রাবণেরও পথচলা শুরু হতে পারে বৃষ্টিধারায়। আগামী মধ্য আগস্টে বিদায় নেয়ার আগে শ্রাবণজুড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি এ মাসে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি বর্ষাকালীন লঘুচাপও সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি নিম্নচাপে রূপ নিতে পারে। এছাড়া, মৌসুমী বৃষ্টিপাতের প্রভাবে চলতি জুলাই মাসের মধ্যভাগে ও শেষার্ধে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আবহাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল রবিবার জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টা দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা একই থাকবে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। তবে, আগামী মঙ্গলবার থেকে সারা দেশের কোনও কোনও এলাকায় বৃষ্টিপাত পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভারী বর্ষণের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ু সল্ডিয় থাকার কারণে রবিবার সকাল দশটা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভ‚মিধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমূদ্রবন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত পয়লা জুলাই আবহাওয়া অধিদপ্তরে বিশেষজ্ঞ কমিটির নিয়মিত বৈঠকে জানানো হয়েছিল, চলতি বছর বিদায়ী জুন মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৭ দশমিক সাত শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হলেও জুলাই মাসে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। জুনে স্বাভাবিক গড় হিসেবে চারশ’ ৪০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলেও অধিদপ্তরে রেকর্ড করা হয়েছে দুইশ’ ৭৩ দশমিক ৯ মিলিমিটার। তবে, স্বাভাবিক ১৮ দিনের স্থলে দেশজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাসের ৩০ দিনই। জুলাইয়ে স্বাভাবিক গড় হিসেবে পাঁচশ’ ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা। তবে, এবার তা চারশ’ ৯০ থেকে পাঁচশ’ ৭০ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। বৃষ্টিপাতের সময়কাল স্বাভাবিক হিসেবে ২২ দিন হলেও এবার তা হতে পারে ২০ থেকে ২৫ দিন। এছাড়া, জুন মাসে বৃষ্টিপাত, লঘুচাপ, কৃষি আবহাওয়া এবং দেশের নদ-নদীর অবস্থা পূর্বাভাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল বলেও উওেল্লখ করা হয়। অধিদপ্তরের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘন্টায় দেশের সবকটি বিভাগেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে পরিমাণ কম হলেও উত্তরাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে। আর চট্টগ্রামের সীতাকুÐে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছাড়াও সদরে ৬৬, স›দ্বীপে ৭২, রাঙামাটিতে ৫৮, কুমিল্লায় ৩৪, নোয়াখালীতে ৭১, ফেনীতে ৬০, হাতিয়ায় ৬২, কক্সবাজার ৪৩ ও কুতুবদিয়ায় ৫৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দস পূর্বদেশকে বলেন, ‘জুলাইয়ের মধ্য ও শেষভাগে মৌসুমী বায়ু দেশের ওপর প্রবলভাবে সক্রিয় হলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে যেতে পারে। একই কারণে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম ও মেঘালয়েও যদি বৃষ্টিপাত বাড়ে তাতে পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার উপরে বইতে পারে। এজন্যই মাসের শেষার্ধে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মধ্যমেয়াদি বন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর অর্থাৎ ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণের উপস্থিতি’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এবার কালবৈশাখী মৌসুমের দৈর্ঘ্য বাড়লেও বিদায় নিতে যাওয়া গ্রীষ্মকালজুড়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে গেছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ কিছু কিছু অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখীর দাপট পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাপদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের প্রধান তিনটি নদী অববাহিকায় তিনশ’ ৪৩ টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্ট থেকে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।