অগ্নিদুর্ঘটনা বেশি ঘটছে বৈদ্যুতিক গোলযোগে

51

ভবন নির্মাণের সময় নকল এবং নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের পাশাপাশি বাসা-বাড়ি এবং অফিস-আদালতে নানা ধরণের ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করতে গিয়ে বাড়তি বিদ্যুৎ প্রবাহের চাপ নকল এবং নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামগুলো নিতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব পণ্য থেকে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন নয় ব্যবহারকারীরা। ফলে, গত কয়েকবছরে অগ্নি-দুর্ঘটনা কিংবা অগ্নিকান্ডের উৎস হিসেবে বৈদ্যুতিক গোলযোগই সবার উপরে উঠে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের গত আট মাসে কেবল নগরীতেই আড়াই শতাধিক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বছরের শুরুতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর চাক্তাইয়ের ভেড়া মার্কেট সংলগ্ন বস্তিতেই আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় নারী-শিশুসহ নয়জন। এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে চমেক হাসপাতাল, কর্ণেলহাট এলাকার পণ্যের গুদাম এবং নগর পুলিশের ডিবি কার্যালয়ে সংঘটিত অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ১ হাজার ৩৭০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৬০ কোটি ৪৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ১১ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হন। এর মধ্যে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলায় ৫৭৭টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন নিহত ও সাতজন আহত হন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় ১১ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
এছাড়া ২০১৭ সালে চট্টগ্রামে ৬৬৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন নিহত ও ছয়জন আহত হওয়ার পাশাপাশি সম্পদের ক্ষতি হয় ৪৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকার। আর ২০১৬ সালে চট্টগ্রামে ৪৯৮টি অগ্নি-দুর্ঘটনায় দুইজন নিহত ও আটজন আহত হওয়ার পাশাপাশি ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকার সম্পদহানি ঘটে।এসব অগ্নি-দুর্ঘটনার ৬০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ।
অগ্নি-নির্বাপণকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, বাসা-বাড়িতে ইন্টেরিয়র পরিবর্তন কিংবা ভেতরে-বাইরে রং করার সংস্কৃতি মানুষ অভ্যস্ত হলেও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পরিবর্তনের চর্চা গড়ে ওঠেনি। ভবন নির্মাণের সময় ওয়্যারিংয়ে যে ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি যুগের পর যুগ ব্যবহার হচ্ছে। যে কোনও পণ্যের যেমন একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে, তেমনি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামেরও লোড নেয়ার ক্ষমতা ও মেয়াদ রয়েছে। কিন্তু ব্যবহার অনুপযোগী না হওয়া পর্যন্ত ভবনে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির বেশিরভাগেই পরিবর্তন করা হয় না। এমনকি, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোরও চর্চা নেই। তার ওপর ভবনের নির্মাণ খরচ কমাতে মালিকদের কেউ কেউ জেনে বা না জেনে নকল কিংবা নি¤œমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন। সেসব পণ্যের গায়ে যে লোড নেওয়ার ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি এবং মেয়াদকাল ছাপানো থাকে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়।
অপরদিকে, সময়ের ব্যবধানে বাসা-বাড়ি ও অফিস-আদালতে নতুন নতুন ইলেকট্রিক গেজেট, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জার, ইলেকট্রনিক চুলা, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইন্টারনেট বা ওয়াই-ফাই সংযোগের রাউটারসহ নানা ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ব্যবহারও ব্যাপকহারে বাড়ছে। বাড়তি বিদ্যুৎপ্রবাহের চাপের বিপরীতে উপযুক্ত ধারণক্ষমতাহীন নি¤œমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম লোড নিতে না পারায় অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, অধিকাংশ ভবনে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এগুলো অগ্নিঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ভবনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত আসবাব ও ইলেকট্রনিক পণ্যের ব্যবহার আগুনের ঝুঁকি দ্বিগুণ করে। অন্যদিকে, আইন অনুযায়ী, ভবনের কাজ শুরুর আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে অনাপত্তি পত্র নেওয়ার যে বিধান আছে, নগরীর ৯৩ শতাংশ ভবনের সেই অনাপত্তি পত্র নেই। আইনে ভবন নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ক ছাড়পত্র নেওয়ার যে বিধান রয়েছে সেটি ৯৭ শতাংশ ভবন মালিকেরই নেই। প্রতি দু’বছর অন্তর একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক স্থাপনা, ফিটিংস ও ওয়্যারিং পরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক হলেও এসব অনুসরণ করা হয় না।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, নগরীতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দশটি স্টেশন রয়েছে। এছাড়া নতুন আরও চারটি আধুনিক ফায়ার স্টেশন স্থাপনের প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিদ্যমান দশটি ফায়ার স্টেশন হল- ইপিজেড, বন্দর, নিউমুরিং, সমুদ্রগামী, আগ্রাবাদ, চন্দনপুরা, নন্দনকানন, লামা বাজার, কালুরঘাট এবং বায়েজিদ স্টেশন। এছাড়া নতুন যে চারটি স্টেশন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে সেগুলো হল- হালিশহর, পতেঙ্গা, কর্ণফুলী এবং পাহাড়তলীতে। এ চারটি স্টেশন নির্মিত হলে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে অগ্নি-দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ত্বরান্বিত হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে, ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় নগরীতে ৪১টি অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ স্পট রয়েছে। এর মধ্যে কালুরঘাট ফায়ার স্টেশনের অধীনে রয়েছে, বহদ্দারহাটের হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সুপার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট এবং বলির হাট মার্কেট। লামা বাজার ফায়ার স্টেশনের অধীনে ভেড়া মার্কেট, চাকতাই চাউল মার্কেট, শুঁটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, মিয়াখান নগর পুরাতন ঝুট মার্কেট এবং ওমর আলী মার্কেট। বন্দর ফায়ার স্টেশনের অধীনে পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রি মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্যাতলী বাজার। ইপিজেড স্টেশনের অধীনে চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসি দীঘির পাড় কলোনি এবং আকমল আলী রোড এলাকাধীন কলোনি। চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের অধীনে চকভিউ সুপার, কেয়ারি শপিংমল ও গুলজার মার্কেট। নন্দনকানন ফায়ার স্টেশনের অধীনে রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরীবাজার ও তামাকুমন্ডি লেন। আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের অধীনে ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেট ও কর্ণফুলী মার্কেট। বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের অধীনে দুই নম্বর গেইট এলাকার রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন রেললাইন সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি এবং শেরশাহ কলোনি।