অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রিয়াজউদ্দিন বাজার

96

চট্টগ্রামবাসীর পছন্দের রিয়াজউদ্দিন বাজারে সামান্য একটি দুর্ঘটনা বা অগ্নিকান্ডে কেড়ে নিতে পারে হাজার হাজার মানুষের জীবন। এলোমেলো তার এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বারবার নোটিশ করে ফায়ার সার্ভিস। একইসাথে ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রশিক্ষণ নিতে বলা হলেও কোন ব্যবসায়ী উদ্যোগ নিতে চান না। সমাধানের প্রসঙ্গ উঠলেই কেউ দায়িত্ব নিতে চান না।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক এবং বহুল পরিচিত রিয়াজউদ্দিন বাজার। অনেকটা কমমূল্যে পণ্য পাওয়া যায় বলে ক্রেতাদের কাছে একটি আকর্ষণের নাম রিয়াজউদ্দিন বাজার। যেখানে পাওয়া যায় গৃহস্থলীর টুকিটাকি জিনিস থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের জিনিস। এটি আবার চাঁটগাবাসীর কাছে পরিচিত ‘রাইত-দিনর’ বাজার। কিন্তু প্রায় সব মার্কেটে এলোমেলো বৈদ্যুতিক তার এবং ইন্টারনেটের তারের কারণে প্রায় শতভাগ মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ সব মার্কেট। যেকোন মুহূর্তে লাগতে পারে শর্ট সার্কিট। তাহলে এ বাজারে গিয়ে শপিং করা কতটা নিরাপদ? প্রশ্ন জনমনে।
সরেজমিন দেখা যায়, এ বাজারে প্রায় ১৫০টি বড়-ছোট মার্কেটের মধ্যে ফুটপাত বাদে দোকান আছে ১০ হাজারেরও বেশি। যার কারণে এক গলি দিয়ে ঢুকলে অন্য গলি দিয়ে বের হতে পথ হারিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। প্রত্যেক মার্কেটের দোকানের সামনে রয়েছে এলোমেলো তার। তবে কোনটা কিসের তার সেটি বলা মুশকিল। কয়েকটি দোকানের কর্মচারীদের কেউ বললো বিদ্যুতের আবার আর কেউ বললো ডিস ও ইন্টারনেটের। তবে বিদ্যুৎ, টিএন্ডটি, ডিস ক্যাবল এবং ইন্টারনেটের তারই রয়েছে। এলোমেলো থাকার কারণে কোনটা কিসের বলা কঠিন। দৈব দুর্বিপাকে যদি কোন অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে তবে নিমিষেই ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেট পরিণত হতে পারে মৃত্যুপুরীতে। আবার ছোট একটা শর্টসার্কিট হলে পুড়ে যেতে পারে হাজার হাজার দোকান। শতাধিক মার্কেটে ছোট গাড়ি প্রবেশের জন্য প্রধান সড়কের পাশাপাশি আছে মাত্র ২টি ছোট সড়ক। একটি আরএস রোড আর তামাকুমন্ডি লেন। কিন্তু সেগুলোতেও সবসময় থাকে হকারের ভিড়।
পুরো রিয়াজউদ্দিন বাজারের কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও ৯৫ শতাংশ মার্কেটে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। আবার মার্কেটগুলোতে নিচে দোকান হলেও উপরে সবাই অনেকেই ‘ব্যাচেলর’ থাকেন। কেউ কেউ ব্যবহার করেন সিলিন্ডার গ্যাস। সুতরাং দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি মালিক সমিতি। হাতেগোণা কয়েকটি দোকানে স্ব উদ্যোগে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র) রাখতে দেখা গেলেও বাকিরা এসব বিষয় নিয়ে তোয়াক্কাও করেন না। এ বিষয়ে কথা বললে দোকানদাররা বলে- আল্লাহ সহায়।
এতসব সমস্যা থাকার পরেও কেনাকাটার জন্য সবাই ভিড় জমায় এখানে। সাধারণ মানুষ বুঝে না যেকোন মুহুর্তের দুর্ঘটনায় হারাতে পারে নিজের অমূল্য জীবন।
কেনাকাটায় আসা গৃহিণী মোর্শেদা বেগম জানান, সবকিছুর দামে কম এবং মানের কারণে রিয়াজউদ্দিন বাজারে আসি। মার্কেটের ভেতরে ঢুকলেই এক ধরনের গরম লাগে। কারণ ভেতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। তারপরও ঘেমে গেলেও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে চলে যাই।
কলেজ ছাত্রী শাকিলা বলেন, মার্কেটে ঢুকার পরে মনে একটা ভয় কাজ করে। কোন্ সময় কোন্ দুর্ঘটনায় পড়ি, তার ঠিক নেই। ঢাকার অনেক বড় বড় মার্কেটে আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকার কারণে মৃত্যুযাত্রী হতে হয়েছিলো।
মোবাইল ফোন ঠিক করতে আসা তারেক আজিজ জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজারে আসি শুধু কয়েকটা জিনিস যাচাই-বাছাই করে নিতে। তা নাহলে এ ভূতুড়ে মার্কেটে আসতামই না।
প্যারামাউন্ট সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী ইমন বলেন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমি চাই প্রতিটি মার্কেটে এ ব্যবস্থা থাকুক। আমাদের এখানে কোন মার্কেটে আগুন লাগলে, তা নির্বাপণ করার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আর খোদা না করুক, যদি আগুন লাগে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা কখনো পোষানো সম্ভব হবে না আমাদের। তামাকুমুন্ডি লেন বণিক সমিতি এবং অন্যদর প্রতি অনুরোধ থাকবে এ ব্যাপারে যেন একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেন।
তামাকুমন্ডি লেন বণিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, এখানে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ইন্টারনেট ওয়ালাদের তার। তাদের অনেকবার বলেছি সংযোগ না দিতে। কিন্তু কথা শোনেনি। আমাদের প্রত্যেক মার্কেট এবং সদস্যদের এ ব্যাপারে কয়েকবার বলার পরে কিছু দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রেখেছে।
তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থেও কেন লাগাচ্ছে না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে আমরা তো মার্কেটের মালিক না? সমিতি থেকে অনেকবার বলেছি, কথার কর্ণপাত না করলে কি করার আছে। ফায়ার সার্ভিসের অফিসাররাও এসে বলে গেছেন, তাতেও কাজ হয়নি।
সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনছুর আলম চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের সহায়তায় আমরা কিছু কাজ করেছি। কিন্তু ওই প্রকৌশলী বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে আর কোন কাজ করতে পারিনি। নতুন প্রকৌশলী যদি চান, তবে আমরা পুনরায় তারগুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উদ্যোগী হবো।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সহকারী পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন পূর্বদেশকে জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজারের যেসব মার্কেট আছে, সেগুলো শুধু ঝুঁকিতে নয় মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। ওখানে গ্যাস লাইন, বিদ্যুত লাইন, ইন্টারনেট লাইন এবং টেলিফোনের লাইন রয়েছে এলোমেলোভাবে। দুর্ঘটনা ঘটলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী ঘটবে তা নিশ্চিত। এ মার্কেটের ভিতরকে আমি ভূতের গলি বলি। কারণ নতুন কেউ ভেতরে ঢুকলে বের হওয়ার জন্য পথ খুঁজে পায় না। সেখানে অগ্নিপাতের মত বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলেতো প্রাণহানি হবেই।
তার প্রতিকার কেন হচ্ছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, ওখানে আগুন নেভানোর গাড়ি প্রবেশ করা সম্ভব না। আর এসব ব্যাপারে মার্কেট মালিক সমিতির দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী এক দোকান থেকে আরেক দোকানের দূরত্ব সাড়ে তিন মিটার। কিন্তু কে শোনে কার কথা? যে যার মত দখল করে ব্যবসা চালাচ্ছে। আমরা তাদেরকে অনেকবার নোটিশ করেছি, তবুও কাজ হয় না। আমরা অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রয়োজনে তাদের ৪০জন করে গ্রূপ করে প্রশিক্ষণ দিবো। যেমনটি এর আগে আমরা টেরিবাজারে দিয়েছি। কিন্তু তাদের সমিতির পক্ষ হতে আগে উদ্যোগ নিতে হবে। ৪০ জন প্রশিক্ষণ নিলে আশপাশে আরও হাজারও মানুষকে তারা সচেতন ও সতর্ক করাতে পারবে।