অগ্নিঝুঁকিতে নগরীর মার্কেটগুলো

57

শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। সারাদেশে কোন না কোন জায়গায় অগ্নিকাÐের দুর্ঘটনার খবর আসলেও নগরীর বহুল পরিচিত ঝুঁকিপূর্ণ ২৯ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেননি। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেয়া হলেও গুরুত্বই দিচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের এসব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ফায়ার লাইসেন্স ইস্যু আর নবায়ন করছে না। তবে শুধুমাত্র যেসব ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ফায়ার লাইসেন্স ইস্যু করেছেন। সুতরাং ২৯ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ফায়ার লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করছেন।
অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ২৯ মার্কেটের মধ্যে রয়েছে- কালুরঘাট ফায়ার স্টেশন এলাকার হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া মার্কেট ও বলির হাট মার্কেট। লামা বাজার ফায়ার স্টেশন এলাকার ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আসদগঞ্জ, মিয়া খান নগর পুরাতন জুট মার্কেট এবং ওমর আলী মার্কেট। বন্দর ফায়ার স্টেশন এলাকার পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রী মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়া বাজার মার্কেট ও ফইল্লাতলি বাজার। ইপিজেড ফায়ার স্টেশন এলাকার চৌধুরী মার্কেট ও কলসি দীঘির পাড় এলাকাধীন মার্কেট। চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন এলাকার চক ভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল ও গোলজার মার্কেট। নন্দনকানন ফায়ার স্টেশন এলাকার রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরি বাজার ও তামাকুমÐি লেইন।
অপরদিকে আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশন এলাকায় রয়েছে সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট এবং কর্ণফুলী মার্কেট। তবে বায়েজিদ ফায়ার স্টেশন এলাকাতে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় কোনো মার্কেট নেই।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে ফায়ার লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন করা হবে। তারা আরও জানান, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা তৈরি করার পর থেকে ফায়ার সার্টিফিকেটের জন্য আমরা বারবার ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে ধর্ণা দিয়েছি। তাদের বারবার অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম কিনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হলেও মার্কেট কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
কর্মকর্তারা বলেন, শীতকালে আগুন লাগার প্রবণতা বেশি থাকে। সাধারণত ১৬ নভেম্বর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব শুষ্ক থাকে। এই সময়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটলে দ্রæত ছড়িয়ে যায় আগুনের শিখা। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অগ্নিনিরাপত্তায় আমরা খুব বেশি সচেতন নই। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও খুব বেশি হয়। প্রায় আবাসিক ভবন ও বাণিজ্যিক ভবন আইন মেনে নির্মিত হচ্ছে না। গলিগুলো অত্যন্ত সরু। এসব গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশও অসম্ভব। এছাড়া পুকুর কিংবা জলাধার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে অগ্নিকাÐের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে দেখে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার থাকে না। তাই অগ্নিনিরাপত্তা আইন মেনে প্রত্যেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখতে হবে। পাশাপাশি আগুন নেভাতে শপিং সেন্টারগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকা, জরুরি প্রস্থানের সিঁড়ির সংখ্যা ও ছয়তলার ওপরে প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্স নিরাপদ অবস্থানে থাকা, স্মোক ও হিট ডিটেক্টর রাখার পাশাপাশি মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
এদিকে নগরীর অগ্নিঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় অগ্নিদুর্ঘটনায় পর্যাপ্ত পানির সংস্থানের জন্য ২৬৮টি স্পটে ২৮০টি ফায়ার হাইড্রেন্ট বসাতে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে লিখিতভাবে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এসবের মধ্যে আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশন এলাকায় ৪৯টি, নন্দনকানন ফায়ার স্টেশন এলাকায় ৪৩টি, চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন এলাকায় ৩৫টি, লামার বাজার ফায়ার স্টেশন এলাকায় ২৬টি, ইপিজেড ফায়ার স্টেশন এলাকায় ৩৫টি, কালুরঘাট ফায়ার স্টেশন এলাকায় ৩০টি, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশন এলাকায় ২৬টি, কোরিয়ান ইপিজেড ফায়ার স্টেশন এলাকায় ১৮টি এবং বন্দর ফায়ার স্টেশন এলাকায় ১৮টি হাইড্রেন্ট বসানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
তামাকুমÐি লেইন বণিক সমিতির সভাপতি শামসুল আলম পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের প্রত্যেক মার্কেট এবং সদস্যদের এ ব্যাপারে কয়েকবার বলার পরে কিছু দোকানে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রেখেছে।
তাদের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থেও কেন লাগাচ্ছে না প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে আমরা তো মার্কেটের মালিক না? সমিতি থেকে অনেকবার বলেছি, কথার কর্ণপাত না করলে কি করার আছে। ফায়ার সার্ভিসের অফিসাররাও এসে বলে গেছেন, তাতেও কাজ হয়নি।
নগরীর পৌর জহুর হকার্স মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফজলুল আমিন বলেন, মার্কেটে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষে ইতোমধ্যে আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এছাড়া কয়েক দফায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস আমাদের কয়েকজন লোককে অগ্নিনির্বাপণে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও বলেছেন। আমরা দ্রæত শতভাগ ব্যবসায়ীকে অগ্নিনিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসবো। ইতোমধ্যে অনেক ব্যবসায়ী ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়েছেন।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, অগ্নি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মার্কেট মালিক সমিতির দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী এক দোকান থেকে আরেক দোকানের দূরত্ব সাড়ে তিন মিটার। কিন্তু কে শোনে কার কথা? যে যার মত দখল করে ব্যবসা চালাচ্ছে। আমরা তাদেরকে অনেকবার নোটিশ করেছি, তবুও কাজ হয় না। আমরা অগ্নি নির্বাপণ সম্পর্কে সচেতন করার জন্য প্রয়োজনে তাদের ৪০জন করে গ্রæপ করে আমরা প্রশিক্ষণ দিবো। যেমনটি এর আগে আমরা টেরিবাজারে দিয়েছি। কিন্তু তাদের সমিতির পক্ষ হতে আগে উদ্যোগ নিতে হবে। ৪০ জন প্রশিক্ষণ নিলে আশপাশে আরও হাজারও মানুষকে তারা সচেতন করিয়ে দিয়ে সতর্ক করাতে পারবে এবং প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয়মাস পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ফায়ার লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন কার্যক্রম বন্ধ রেখেছি। অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হলে আমরা পুনরায় চালু করবো বলে জানিয়েছি। তবে যেসব ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানি কাজে জড়িত তাদের শর্ত সাপেক্ষে ফায়ার লাইসেন্স দিয়েছি। আমরা বলেছি, দ্রæত যেন অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ অক্টোবর নগরীর জহুর হকার্স মার্কেট সংলগ্ন জালালাবাদ মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়।