অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি কমাতে কারও ‘গরজ নেই!’

45

উদাসীনতার পাশাপাশি ঘনবসতি ও সংকীর্ণ সড়ক এবং প্রতিনিয়ত কমতে থাকা পানির উৎস সম্ভাব্য অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি হ্রাসের বদলে দুর্ঘটনাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলছে। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ সতর্ক করার পরও ঝুঁকি হ্রাসের গরজবোধ করছে না কেউই। বরং ‘অনিবার্য পরিণতি’ মেনে নিয়েই অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে যেমন নিত্যদিনের কারবার চলছে তেমনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতেও বসবাস করছে সাধারণ মানুষ।
অপরদিকে দ্রূততম সময়ে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি হাজির হলেও পর্যাপ্ত পানির উৎস না থাকায় অগ্নি নির্বাপনে হিমশিম খেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দু’বছর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও নির্বাপণ’ বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সভায় নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ ও সংকীর্ণ এলাকায় ওয়াসার হাইড্রেন্ট (সড়কের পাশে পানির কল) বসানোর প্রস্তাব করা হলেও অদ্যাবধি তা আলোর মুখ দেখেনি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীতে বর্তমানে শিল্প-কারখানা, গুদাম, মার্কেট ও বসতি মিলিয়ে চার শতাধিক স্থাপনা অতিমাত্রায় অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বা অধিকতর ঘিঞ্জি এলাকা হিসেবে পরিচিত রেয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, কর্ণফুলী সিঙ্গাপুর মার্কেট এবং আগ্রাবাদের মোগলটুলী, মাদারবাড়ি, বাকলিয়ার মিয়াখাননগর, পাহাড়তলীর আমবাগান, ইপিজেডের কলসী দীঘির পাড়, বায়েজিদ শেরশাহ এলাকার বেশকিছু কলোনি রয়েছে ভয়াবহ অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে। এসব এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতিরও শঙ্কা রয়েছে। কারণ, এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা চলাচলের সড়কগুলো এতই সরু ও সংকীর্ণ যে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ও দমকল কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছানো একপ্রকার অসম্ভব। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটায় নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ শুলকবহরের ডেকোরেশন গলির শেষ মাথায় বাবু কলোনিতে টিনশেড ঘরগুলোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট এক থেকে দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। খবর পাওয়ামাত্রই দমকলকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হলেও কলোনিতে ঢোকার সড়কের সংকীর্ণতা এবং নিকটবর্তী দুরত্বে পানির পর্যাপ্ত উৎস না থাকায় অগ্নি নির্বাপনে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় কলোনির আট মালিকের সবমিলিয়ে অন্তত একশ’টি টিনশেড কাচাঘর পুড়ে গেছে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলেই প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস।
দুর্ঘটনাস্থলে ছিলেন আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী। কলোনিতে ঢোকার সড়কটি বেশি সংকীর্ণ হওয়ায় দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি নিতে খুব বেগ পেতে হয়েছে জানিয়ে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, সড়কের সংকীর্ণতার কারণে আমাদের বিকল্প পথ খুঁজতে হয়েছে। আশপাশের তিনটি উঁচু ভবনের ছাদ থেকে আমরা দুর্ঘটনাস্থলে পানি ছিটিয়েছি। আবার দুর্ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী কোথাও পানির সহজ উৎসও ছিল না। সেটা থাকলে আমরা পাম্প চালু করে পাইপের মাধ্যমে দুর্ঘটনাস্থলে পানি ছিটাতে পারতাম। আর টিনশেড কাচাঘর হওয়ায় আগুনও ছড়িয়েছে দ্রুত। তারপরও প্রশস্থ সড়ক ও পানির পর্যাপ্ত উৎস থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিশ্চিতভাবে আরও কমানো যেত।’
এদিকে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বাণিজ্যিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা গুদাম স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা লংঘন করেই নগরীতে শত শত কেমিক্যাল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ও গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর আছাদগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় টিনশেড ও ঘিঞ্জি পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং স্পিরিটের দোকান ও গুদাম। এসব দোকান ও গুদাম মালিকদের অনেকেরই অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। আবার যারা ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন সেখানেও রয়েছে গোলমাল। অন্যের অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদর্শন করেই সংগ্রহ করা হয়েছে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র। কেউবা ছাড়পত্র নেয়ার পর সেটা আর নবায়ন করেননি। নগরীর বৃহত্তম পাইকারি বাণিজ্যকেন্দ্র আছদগঞ্জের সবকটি কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম মালিক অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র সংগ্রহ করলেও তাদের ৭০ শতাংশ গুদামে কোনও অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম নেই।
অগ্নি-দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকির তালিকায় থাকা রেয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে ছোট-বড় একশ’ ৪০টি মার্কেটে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী, কাপড় ও ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রি করা হয়। মার্কেটের গলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে মানুষের হাঁটা-চলারও সুযোগ নেই। কোথাও দখল করে নেয়া হয়েছে গলির একাংশ। কোথাও চলাচলের পথেই অবৈধভাবে দোকান তুলে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটা যায় না- এমন গলিপথও রয়েছে কোনও কোনও মার্কেটে। এসব মার্কেটে কখনো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি-নির্বাপক গাড়ি ও কর্মীরা প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মার্কেট ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে এলোমেলো অবস্থায় আছে। মার্কেটের ওপরের তলার কক্ষগুলো গুদাম এবং আবাসিকের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া, মার্কেটের ভেতরে বা আশপাশে আগুন নেভানোর মত পানির কোন উৎস নেই। রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। ফলে, মধ্যরাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসারও সুযোগ নেই।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালাগুলো যেমন অনুসরণ করা হয় না তেমনি ফায়ার ছাড়পত্র নিলেও নির্দেশনা অনুসরণে বেশিরভাগই অভ্যস্ত হচ্ছে না। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয়না। ভবন নির্মাণে ত্রূটি থাকায় কোনও কোনও সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রূটিমুক্ত নয়। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। এছাড়া, অপ্রশস্ত সড়ক ও জলাশয় ভরাটের কারণে পানির উৎস কমে যাওয়ায় অগ্নি নির্বাপনে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ করা প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। অগ্নি-দুর্ঘটনার এড়াতে কিংবা ঝুঁকি হ্রাসে নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করলেই আগুন লাগলেও বড় ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।