অকালপ্রয়াত চিরস্নিগ্ধ রমজান আলী মামুন

33

মুহম্মদ নুরুল আবসার

শহর চট্টগ্রামের আদি পুরুষের যোগ্য উত্তরাধিকারী রমজান আলী মামুন। দীর্ঘ চারদশক নগরের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে ধারণ ও লালন করে ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর অকস্মাৎ তার সতীর্থদের সারপ্রাইজ দিয়ে ইহধাম ত্যাগ করে। অজস্র সতীর্থ বন্ধু-বান্ধব এবং স্বজনদের শোক সাগরে ভাসিয়ে নীরবে প্রস্থান করে পৃথিবীর জটিল ও কঠিন কোলাহল থেকে। ঠিক এক বছর পরে এসে স্মৃতির ঝাঁপিতে দেখছি, রমজান আলী মামুন এর সরব উপস্থিতি কোথায় ছিলো না? অথচ আজ চারিদিকে শুধুই শূন্যতা ও হাহাকার। স্মৃতির পাপিয়ারা কাঁদে নিরবে নিভৃতে, হৃদয়ের মসৃন অলিন্দে। রমজান আলী মামুনকে বহুজন বহুভাবে দেখেছেন। আমি আমার মতো দেখেছি। আমার দেখার টুকরো স্মৃতিই এ স্মরণ-লেখার মূল প্রতিপাদ্য। ‘সে ওখানে শুয়েছিল / মুখের আদলে দ্বিধা / তার প্রজ্ঞায় / যে পৃথিবী সম্পৃক্ত ছিল / তা এখন বিচ্ছিন্ন। / মৃত্যুর পরে/ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আশির দশকে গ্রাম থেকে যখন ইট পাথরের এই শহরে যাতায়াত শুরু করি তখনই বন্ধু হিসেবে আপন করে নেয় রমজান আলী মামুন। শহরে এসেই দেখা করতাম তাঁর সাথে, তাঁর টেরীবাজারস্থ বদর পুকুর পাড়ের বাসায়। কতবার যে সেই পুরনো দু’তলার বাসায় গেছি তার কোনো হিসেব নেই। তাকে খুঁজতে গিয়ে পরিচিত হয়েছি তাঁর মায়ের সাথে, তাঁর এক ভাইঝির সাথে (নামটা ভুলে গেছি)। তাঁর পরিবারের সবার সাথে একটা হৃদ্যতা গড়ে ওঠেছিল তাঁর পরিচয় সূত্রে।
লেখাটা শুরু করেছিলাম বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান ধ্রুপদী কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতার ক’টি লাইন দিয়ে। রমজান আলী মামুনও এখন শুয়ে আছে তাঁর মায়ের সাথে। তাঁর মেধা-মনন প্রজ্ঞায় যে পৃথিবীর সাথে সম্পৃক্ত ছিল সে এসব থেকে এখন বিচ্ছিন্ন। তবে স্বল্প সময়ে মামুন যে সৃজন সম্ভার আমাদের উপহার দিয়ে গেছেÑ তার লালন পালন এবং পরিচর্যার দায়ভার আমাদের। তাঁর অপ্রকাশিত লেখার প্রকাশ এবং অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা থেকে কোনোভাবে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। যদি বিচ্যুত হই তবে তাঁর আত্মা কষ্ট পাবে। এ কথাটা আমাদের সবার মনে রাখতে হবে।
যে স্মৃতি শুধুই কাঁদায় সে স্মৃতি প্রকাশ করাও কঠিন। আমি বুঝে উঠতে পারছি না কোনটা রেখে কোনটা লিখি। মাসিক আন্দরকিল্লা’য় একটা শিশুতোষ পাতা চালু করি তারই প্ররোচনায়। পাতার নামটাও তাঁর দেয়াÑ ‘রোদ্দুর’। রোদ্দুর সম্পাদনা সূত্রে আমার অফিসে তাঁর নিত্য আসা যাওয়া। দিনের অধিকাংশ সময় আমার সাথেই থাকত। দুপুরে হোটেলে এক সাথে খাওয়া হতো নিত্য দিন। রোদ্দুরের জন্য লেখা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে তার পুরো সম্পাদনার দায়িত্ব ছিল তাঁর। ওখানে আমার কোনো খবরদারি চলত না। প্রতি সংখ্যায় একজন শিশু সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার থাকত। সে গুলোও মামুন গ্রহণ করত নিষ্ঠার সাথে। আবির প্রকাশন-এর শুরু সম্মিলিত কবিতা সংকলন প্রকাশের মাধ্যমে। প্রথম সংকলনের নাম ছিল ‘উজান যমুনা’। দ্বিতীয় সংকলন ‘বনে নয়, মনে মোর’ ও তৃতীয় সংকলন ‘হৃৎপিন্ডে জ্যোৎস্না’ সম্পাদনা করেছিল রমজান আলী মামুন। এই দুটো কবিতা সংকলন সারা বাংলাদেশের নবীন প্রবীণ কবিদের লেখায় সমৃদ্ধ ছিল। তাঁর সুনিপুণ সম্পাদনায় এই দুটো গ্রন্থ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এরপর আবির প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর কিশোর গল্প ‘কিশোর নেমেছে যুদ্ধে’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই গল্পগ্রন্থটিও বেশ সমাদৃত হয়েছে। আমার প্রকাশনা থেকে তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ‘তোর জন্য কষ্ট আমার’ এটিও একটি নিটোল প্রেমের কবিতায় সাজানো। আমি মনে করি রমজান আলী মামুনকে শিশু সাহিত্যিকের তকমা লাগিয়ে দিয়ে তাঁর প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তাঁর সম্পাদিত দুটো প্রেমের কবিতা সংকলন ‘তোর জন্য কষ্ট আমার’ ও ‘আমার অনেক কষ্ট আছে’ পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রমজান আলী মামুন একজন আপাদমস্তক কবিও।
রমজান আলী মামুন-এর মহাপ্রস্থানে প্রচন্ড সংকটে আছি আমি। আমার নিত্যদিনকার সুখ-দুঃখের সাথী কী অভিমানে আমার কাছ থেকে আড়াল হয়ে গেল জানি না। প্রসঙ্গক্রমে আরেক অভিমানী প্রবাস-কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ গ্রন্থের ‘একদিন কেউ কাউকে চিনবো না’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন- ‘সবই চলে যায়, সবই চলে যাবে একদিন / তবু কেউ কারও মুখ দেখবো না সঠিক / অস্পষ্ট ভালোবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্তত / আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়।’
রমজান আলী মামুন ছিল আবির প্রকাশন ও মাসিক আন্দরকিল্লার আড্ডার অন্যতম প্রাণপুরুষ। তাঁর স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারার মিষ্টি হাসি এবং প্রাণোচ্ছে¡াল আড্ডায় আমরা মেতে থাকতাম অহর্নিশ। কিন্তু আজ মামুন নেই। ভালোবাসার দিনগুলো ফিকে হয়ে গেছে। স্মৃতিরা যন্ত্রণায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাঁর ইচ্ছেগুলো এখন বাতাসে ভেসে ভেসে নীলিমায় মিশে যাচ্ছে। এখন আমরা কেউ কারও মুখ দেখছি না ঠিকই। স্মৃতির জানালা দিয়ে অতীতের সড়ক পথে যেতে যেতে দেখি হাফহাতা শার্ট গায়ে ছাতা ধরে রমজান আলী মামুন ধীর লয়ে হেঁটে যাচ্ছে আন্দরকিল্লার মোড়ে, চেরাগী পাহাড়ের দিকে, বলুয়ার দিঘীর পাড়ে, লালদিঘীতে, শিল্পকলা একাডেমি, টেরিবাজারের গলিতে কিংবা কোনো সভা-সমিতিতে।
আমার জীবনের অনেক ‘প্রথম’-এর সাথে রমজান আলী মামুন জড়িত। যেমন আমার জীবনে প্রথম ঢাকা যাত্রার সঙ্গী ছিল সে। এই শহরের অনেক অলি-গলির পথ চিনিয়েছিল মামুন। অনেক বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মামুন। আমার সম্পাদিত প্রথম কবিতা সংকলনের সাথী ছিল মামুন। এই রকম আরও শত ‘প্রথম’-এর বর্ণনা করে এই নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না।
শহর চট্টগ্রামের আদি মানুষের বংশধর মামুন ছিল অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাদা মনের মানুষ। মানুষের উপকার করাই ছিল তাঁর ব্রত। একদিন আমি অফিসে বসা অবস্থায় হঠাৎ প্রচন্ড পেট ব্যথায় আক্রান্ত হলে মামুন একাই আমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করায়। তখন আমি গ্রামে থাকতাম। শহরে কেউ ছিল না। তাঁর সেদিনের ভূমিকা আজ আমাকে নতুন করে কাঁদায় এই জন্য যে, আমি তাঁকে মেডিকেলে দেখতে যাওয়ার আগেই সে চলে গেল পরপারে। এ ব্যথা, এ যাতনার বিষে বিষে আমি এখন নীল। শুধু আমাকে নয়, যখন যার বিপদ হয়, সমস্যা হয়, সবার আগে ছুটে আসত মামুন। তাঁর এ গুণ সকল স্বজনকেই এখন কাঁদাচ্ছে অবিরত। রমজান আলী মামুনকে আমি প্রায় সময় একটা কথা বলতামÑ আমাদের বন্ধুত্ব সময়ের তিন দশকে অনেক পরিবর্তন দেখলাম। অনেক উত্থান পতন দেখলাম। তবে আমরা ক’জন মানুষের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেখানেই ছিলাম সেখানেই রয়ে গেছি। এ ক’জন মানুষের মধ্যে আছি আমি, মামুন, ফারুক হাসান, সাঈদুল আরেফীন, ইফতেখার মারুফ ও রফিক উদ্দিন চৌধুরী। মামুন আমার কথায় সায় দিত এবং এই কথাটা আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিত।
রমজান আলী মামুন-এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এই সীমাবদ্ধতার কারণে বৈষয়িকভাবে সফল হতে পারে নি। এই জন্য তাঁর কোনো দুঃখ ছিল না। তবে মনটা ছিল উদার, আকাশের মতো বিশাল। সাগরের মতো গভীর। এই টানাপড়েনের মধ্যেও সে নিবিড়ভাবে পরিচর্যা করে গেছে সাহিত্য কর্মের। সৃষ্টি করেছে বহু ছড়া, গল্প, কবিতা। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছে শিশুতোষ কাগজ- ‘কিশোর সমাবেশ’। তাঁর প্রকাশিত মোট গ্রন্থ ১৫টি, সম্পাদিত গ্রন্থ ২টি। যা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুদিন।
রমজান আলী মামুনের স্বল্পায়ুর এ জীবনে অনেক কষ্ট ছিল। শৈশবে পিতাকে হারিয়ে এতিম হয়েছে। সেই কষ্ট বুকে ধারণ করে রমজান আলী মামুন বেড়ে ওঠেছে। জীবন সংগ্রামে নানা টানাপড়েন এর মাঝেও এক অভাবনীয় মা ভক্ত মামুনকে আমরা দেখতে পায়। বৃদ্ধ-অসুস্থ-অচল মাকে মামুন পরম মমতায় যেভাবে সেবা-যতœ করেছে তা এ যুগে বিরল ও অনুকরণীয়। বাহ্যিকভাবে মামুনকে হাসি-খুশি দেখালেও তার ভেতরে কষ্টের ধোয়াগুলো উদগীরন হতো ভয়ংকর লাভার মতো। তার দুটো গ্রন্থের নামাকরণ করেছে ‘কষ্ট’ শব্দটা ব্যবহার করে। ‘তোর জন্য কষ্ট আমার’ এবং ‘আমার অনেক কষ্ট আছে’। এই কষ্টের মাঝেই বন্ধুবাৎসল্য মামুন নির্দিষ্ট একটা গÐির মধ্যে না থেকে সর্বমহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল তার স্বভাবজাত সারল্যগুণের কারণে। বহুমাত্রিক মানুষের সাথে ছিল তার সহজিয়া সম্পর্ক। তার চাপ দেখা যায়, তাঁর নানা লেখা-লেখিতেও। তার একটি কবিতার শিরোনাম- জীবন এক কষ্ট নদীÑ ‘অনেক বিনিদ্র রজনী / দীঘল পথ সাঁতরে এলাম / না পাওয়া বেদনায় নীল হতে হতে / পুষে রেখে তুষের আগুন/ দেহটাকে পুড়িয়েছি ঢের / অথচ হায়রে জীবন / কষ্টগুলো নীংড়ে মাটি / সম্মুখে ঘুরে আসে ফের।’ -(তোর জন্য কষ্ট আমার) রমজান আলী মামুনের কষ্টময় জীবনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর ‘আমার অনেক কষ্ট আছে’ কবিতায়। সেখানে মামুন বলেছেÑ ‘আমার অনেক কষ্ট আছে / পাথর চাপা কষ্ট, / সে কষ্টের উৎসধারা / কখন সে হয় বাঁধন হারা / নষ্ট হবে কষ্টগুলো / বলি না তাই স্পষ্ট / আমার অনেক কষ্ট আছে / পাথর চাপা কষ্ট।’
এই পাথরচাপা কষ্ট নিয়ে মামুন হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের মতো। এই অভিমানী বন্ধুটির সাথে ছিল আমার তিরিশ বছরের সম্পর্ক। তিরিশ বছরের অকৃত্রিম স্মৃতির পাতাগুলো এখন গভীর শোকে মুহ্যমান। রমজান আলী মামুনের মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকীতে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব করুন। আমিন।
লেখক : সম্পাদক, মাসিক আন্দরকিল্লা