মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং কবি আল মাহমুদ

431

 

ইতিহাসের নানা আন্দোলন-সংগ্রামের বাঁক পেরিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ। এই জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির প্রধান কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর আহব্বানে সাড়া দিয়ে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক জাতির প্রয়োজনে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম।
কারো কারো অভিযোগ, আল মাহমুদ স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু লেখেননি। মহান মুক্তিযুদ্ধনির্ভর এবং বঙ্গবন্ধুর বীরত্বগাঁথায় ভরপুর “উপমহাদেশ” বা “কাবিলের বোন”র মতো মোটা উপন্যাস পড়ার সময়ও তাদের নেই। আল মাহমুদের “নিশি ডাক” কবিতা দেখার পর তারা হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো! কারণ, এই কবিতার চেয়ে শক্তিশালী কোন কবিতা অদ্যাবধি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কেউ লিখতে পারেনি। তাই তারা সুপরিকল্পিতভাবে নতুন গল্প তৈরী করলো। গল্পটা অনেকটা এমন, আল মাহমুদ স্বাধীনতা বা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জীবনে কোন লেখা লিখেননি। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রথমবারের শাসনামলে হঠাৎ “নিশি ডাক” লিখে বেবী মওদুদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। একজন তো রীতিমতো ফেসবুক লাইভে এসে “নিশি ডাক” প্রকাশের সময়কাল বিশ্লেষণপূর্বক কবিতার পটভূমি বয়ান করা শুরু করেছেন। “নিশি ডাক” কবিতাটি আল মাহমুদের কোন গ্রন্থে না থাকার প্রসঙ্গ টেনে নেতিবাচক কথা বলছেন।
একটি কবিতা কোন গ্রন্থে গ্রন্থিত না হবার নেপথ্যে কোন ইতিবাচক কারণ কী থাকতে পারে না?
কবিতাটি নিয়ে বিরুদ্ধাচরণকারীদের এতো মাথাব্যথা কেন? আসুন, দেখে আসি কবিতাটিতে কী বলা হয়েছে! কবি আল মাহমুদ তাঁর “নিশি ডাক” কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকাব্যটি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন সেটি খুবই উচ্চমার্গীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ। “নিশি ডাক” কবিতার কোথাও সরাসরি বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, ৭ মার্চ এসব শব্দের উল্লেখ নাই। কবিতা সমঝদার ব্যতীত অন্য কেউ খুব সহজে কবিতাটি বুঝতে পারবে না – এটি যেমন সত্য, ঠিক তেমন সামান্য ইঙ্গিত দিলে অন্ধও স্বাচ্ছন্দে আস্বাদন করতে পারবে কবিতার গভীরে লুকিয়ে থাকা অমৃত স্বাদ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য খ্যাতিমান, কম খ্যাতিমান বা অখ্যাত কবি সহগ্রাধীক কবিতা লিখলেও আল মাহমুদ মাত্র একটি কবিতা লিখেছেন (বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাসূচক অসংখ্য গদ্য আল মাহমুদ সৃষ্টি করেছেন)। বিনাদ্বিধায় বলা যায়, শিল্পের বিবেচনায় এই একটা কবিতাই সহগ্র কবিতার সমান। আল মাহমুদ বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে উপস্থাপন করেছেন, “সে যখন ডাকল ‘ভাইয়েরা আমার’/ভেঙ্গে যাওয়া পাখির ঝাঁক ভিড় করে নেমে এলো পৃথিবীর ডাঙ্গায়/কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগল খোলা ময়দানে।” কারণ, “তাঁর আহব্বান ছিলো নিশিডাকের শিসতোলা তীব্র বাঁশির মতো।” ভাবা যায়, কী শক্তিশালী কথামালা জুড়ে দিলেন কবিতায়! বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিলো এমন প্রেরণাদায়ক ও উজ্জ্বীবনীমূলক যে, মানুষ জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে পতঙ্গের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তাঁর ভাষণকাব্য এতোাঁই শক্তিশালী ছিলো – “কবিরা কলম ও বন্দুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে লাগল খোলা ময়দানে।” বঙ্গবন্ধুর ‘ভায়েরা আমার’ আহব্বানে “প্রতিটি মানুষের রক্তবাহী শিরায় কাঁপন দিয়ে তা বাজতো/নদীগুলো হিসহিস শব্দে অতিকায় সাপের মতো ফুা তুলে দাঁড়াতো/অরণ্যের পাখিরা ডাকাডাকি করে পথ ভুলে উড়ে যেতো সমুদ্রের দিকে।” আবার স্বাধীনতা মহাকাব্যের মহাকবি যখন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্সে পঠিত তাঁর কবিতায় বললেন ‘ভাইসব’, “অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল।” মানুষ তো কীটপতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। এমনকি নিরীহ শব্দশিল্পীরাও কলমের পরিবর্তে আগুনের গোলা হাতে তোলে নিলো, “এই আমি/নগণ্য এক মানুষ/দেখি, আমার হাতের তালু ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে/এক আগুনের জিহব্বা।” এটি চিরন্তন সত্য যে বঙ্গবন্ধুর আহব্বানেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তির সংগ্রামে। তাঁর ঘোষণায় নিশ্চিত মৃত্যু যেনেও মানুষ হাতে তোলে নিয়েছিলো আগ্নেয়াস্ত্র। নিরীহ নারী-পুরুষ সাহসী হয়ে রুখে দাঁড়াবার দৃষ্ঠতা দেখিয়েছিলো, “বলো, তোমার জন্যই কি আমরা হাতে নিইনি আগুন?/নদীগুলোকে ফুা ধরতে শেখায়নি কি তোমার জন্য/শুধু তোমারই জন্য গাছে গাছে ফুলের বদলে ফুটিয়েছিলাম ফুলকি/আম গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফলেছিল/গ্রেনেড ফল। আর সবুজের ভেতর থেকে ফুৎকার দিয়ে/বেরিয়ে এলো গন্ধকের ধোঁয়া।”
অনেকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ডজন ডজন কবিতা লিখেছেন। আবার তারাই স্বাধীনতার পূর্বে জিন্নাহর স্তুতি বর্ণণামূলক অসংখ্য কবিতা প্রসব করেছিলেন। আল মাহমুদ কিন্তু একটাও লিখেননি। বরং প্রতিবাদী কবিতা লিখে পাকিস্তানি শোষকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আল মাহমুদ তাদের মতো তোষামুদে সাহিত্যিক ছিলেন না। বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি প্রশ্ন, তিনি বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কাকে কাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন? হযরত মুহাম্মদ (সঃ), ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখ, মওলানা ভাসানীসহ অনেককে নিয়েই লিখেছেন। এমনকি তাঁর শেষ জীবনের একান্ত সহকারী কবি আবিদ আজমকে নিয়েও একটা কবিতা লিখেছেন। একটার বেশী কি কাউকে নিয়ে লিখেছেন? হতে পারে কবিতার ক্ষেত্রে এটি তাঁর নিজস্বতা।
আল মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে তোষামুদে সাহিত্যের বিপক্ষে। স্বাধীনতার পূর্বেই দরবারি তোষামুদে সাহিত্যের কঠোর সমালোচনা করে লিখেছিলেন,
“পূর্ব পুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রি করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাওল – রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।”
(সোনালী কাবিন)
ঐ ভদ্রলোকেরা কীভাবে চিন্তা করলো, এমন কবিতার রচয়িতা কবি বিশেষ দরবারি সুবিধার জন্য “নিশি ডাক” রচনা করেছেন!
আল মাহমুদ শুধু কবি নন, তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শুদ্ধ ও শক্তিশালী কথাশিল্পী। স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর আরো কবিতা আছে, কথা আছে। এমন নয় যে, বাংলাদেশ হঠাৎ টুপ করে লাফ দিয়ে ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীতে অবতরণ করেছে। এই দেশ সৃষ্টির ইতিহাস তো অনেক লম্বা! স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছিলো ভাষা আন্দোলন হতে। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কবিতা লেখার অপরাধে তাঁর উপর হুলিয়া জারি করা হয়েছি। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তাঁর লেখা রাজপথে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিলো। কবি নিজের আত্মজীবনীতে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরীকারী ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করছেন,-
“ভাষা আন্দোলন কমিটির একটি লিফলেটে আমার চার লাইন কবিতা যেদিন ছাপা হয়ে মুহাম্মদ মুসার কাছে আসে ঠিক সেদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশ হানা দেয়। লিফলেটগুলো তখনও বিলি হয়নি। —-আমি আমাদের বাড়ির গেটে এসে পৌঁছা মাত্রই পুতুল নামে আমার এক বোন, যে ছিল একদা শোভার সহপাঠিনী, শিক্ষক ও সাংবাদিক গফুর মাস্টারের মেয়ে – কোথা হতে দৌঁড়ে এসে বলল, পালাও। তোমাদের ঘরবাড়ি পুলিশ সার্চ করছে। তোমাকে খুঁজছে। বইপত্র সব তছনছ করে কী যেন খুঁজছে।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৯৫)
বাঙালির ধারাবাহিক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলনে বারুদের মতো কাজ করলো আল মাহমুদের “উনসত্তরের ছড়া”,-
“ছড়াটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানান আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। গলায় হারমোনিয়াম জড়িয়ে ছাত্র-শিল্পীরা গেয়ে উঠেছিলো,
“কোথায় পাবো মতিউরকে
ঘুমিয়ে আছে সে
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩০৯)
বাংলা ভাষার প্রধান কবি আল মাহমুদ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে শুধু কবিতাই লিখেননি, সুস্পষ্ট বক্তব্যও দিয়েছেন,-
“৭ মার্চের ভাষণে তিনি তার জাতিকে পরিষ্কারভাবে বলে দিলেন, তোমাদের কাছে যা কিছু আছে ওইসব নিয়েই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। এটা ছিলো বাঙালি জাতির এক মহাসিদ্ধান্তসূচক পথনির্দেশনা।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩২৪)
আল মাহমুদ ২৫ মার্চ কালরাতে ইত্তেফাক অফিস হতে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পরই শুরু হয়ে যায় হানাদার বাহিনীর নির্মমতা। তিনি সে সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছেন জগৎখ্যাত দার্শনিক বা শীর্ষ বুদ্ধিজীবীর মতো,- “কানফাটা এ শব্দের অবিশ্রান্ত গর্জনে আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এত ভয়াবহ শব্দ হচ্ছে কেন? আমি তাকে মৃদু ভাষায় বললাম, অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগে যে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে আজ রাতে তা ভেঙে যাচ্ছে। এটা হলো পাকিস্তান ভাঙার আওয়াজ।-পাকিস্তান গড়ার পিছনে পাঞ্জাবিদের সামান্যতম কোন অবদান নেই। নেই পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীরও। পাকিস্তান চেয়েছিল বাঙালি মুসলমান।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩২৪-৩২৫)
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অসংখ্য ঘটনা কবি নিজের লেখা উপন্যাস “কাবিলের বোন” ও “উপমহাদেশ”এ সন্নিবেশিত করেছেন। এসব ঘটনা কবিতার চেয়ে উপন্যাসে প্রকাশের কারণে সর্বসাধারণের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে ও বুঝতে সহজ হয়েছে,- “ইতিহাসের এ পর্যায়ের অনেক ঘটনা আমি আমার উপন্যাস “উপমহাদেশ” এ লিখেছি। এ ভাঙনের ইতিহাস আমি লিখেছি “কাবিলের বোন” নামক একটি উপন্যাসে। কারণ আমি জানতাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হবে। কবিরা কখনও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না। আমি আমার জাতির ইতিহাস, স্বাধীনতার স্পৃহা ও যুদ্ধের ঘটনাবলী বর্ণনা করেছি। এর বেশি একজন কবি কি-ইবা করতে পারে।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩২৫)
উপন্যাস দু’টি সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন উপস্থাপন করতে গিয়ে কবি অন্যত্র লিখেছেন,- “উপমহাদেশ’ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আমার প্রথম বড় রচনা। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে এই বইটির মৌলিক পার্থক্য আছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না কিম্বা মুক্তিযুদ্ধের সংঘাত, সংঘর্ষ নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেননি তারাও মুক্তিযুদ্ধের উপর সার্থক গ্রন্থ রচনা করেছেন। আর আমি তো -” সাভাবিকভাবেই কবি নিজে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার কারণে তাঁর লেখার সাথে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাদের লেখার মৌলিক পার্থক্য থাকবেই।
এই দু’টি উপন্যাসে রূপক-উপমায় কর্মবীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চমর্যাদা, মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ধোষণা ও নেতৃত্বদান, মহান মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটি বিষয়াবলী বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
১৯৭১ সালে কবি আল মাহমুদ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। রণাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রদান করতেন মোটিভেশনাল স্প্রিট,- “বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকার দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময় হঠাৎ কলকাতার বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু ঘটল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ হতে আমি তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। —একদিন কুষ্টিয়া সীমান্তে এক জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট হাজির হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, প্রায় তিনশ মুক্তিযোদ্ধা ২০টা প্লেটে পর্যায়ক্রমে আহার করেন। আমি উপস্থিত হলে তারা থালা বাজিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাকে পেয়ে তাদের আনন্দ যেন উথলে উঠেছিলো।”
(আত্মজৈবনীক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩৩২-৩৩৮)
বঙ্গবন্ধু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের খুবই ভালোবাসতেন। তার একটি উদাহরণ না দিলেই নয়। এই উদাহরণটি একটি জাতীয় দৈনিকে পূর্বে প্রকাশিত আমার নিবন্ধেও উপস্থাপন করেছিলাম।
সময়টা ১৯৭৩ সাল। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে দুর্ভিক্ষের জোয়ার নেমে আসছে। ইতিপূর্বে পাকিস্তানের গুণকীর্তন করা শিল্প-সাহিত্যের লোকগুলো দলে দলে ভোল্ট পাল্টে খাঁটি বাঙালি বনে গেলো। তাঁরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা সমানতালে ভোগ করছেন। কিন্তু পাকিস্তানপন্থী হবার অপরাধে বাংলাদেশ বেতার থেকে বাঙালি “মুসলিম রেনেসাঁর কবি” ফররুখ আহমদকে চাকরীচ্যুত করা হলো। বরাবরের মতোই আহমদ ছফা ফুঁসে উঠলেন। ১৬ জুন ১৯৭৩ সালে দৈনিক গণকণ্ঠে “কবি ফররুখ আহমদের কী অপরাধ?” শিরোনামে তথ্য ও যুক্তিনির্ভর দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন। তখন গণকণ্ঠের সম্পাদক ছিলেন আল মাহমুদ। ছফা প্রবন্ধটি শুরু করেছেন এক হৃদয়গ্রাহী ঘটনার অবতারণার মাধ্যমে,-
“খবর পেয়েছি বিনা চিকিৎসায় কবি ফররুখ আহমদের মেয়ে মারা গেছে। এই প্রতিভাধর কবি যাঁর দানে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে-পয়সার অভাবে তাঁর মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারেননি, ঔষুধ কিনতে পারেননি। কবি এখন বেকার। তাঁর মৃত মেয়ের জামাই, যিনি এখন কবির সাথে থাকছেন বলে খবর পেয়েছি, তাঁরও চাকুরী নেই। মেয়ে তো মারাই গেছে। যাঁরা বেঁচে আছেন, কী অভাবে, কোন অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিনগুলো অতিবাহিত করছেন, সে খবর আমরা কেউ রাখিনি।”
ফররুখ আহমদের অসাধারণ সৃজনক্ষমতার উল্লেখ করে ছফা লিখেছেন,- “হয়ত একদিন সংবাদ পাব কবি মারা গেছেন, অথবা আত্মহত্যা করেছেন। খবরটা শোনার পর আমাদের কবিতাপ্রেমী মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে? ……হয়ত ব্যথিতই হব এ কারণে যে, আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মতো একজনও শক্তিশালী স্রষ্টা নেই।”
আহমদ ছফার নিবন্ধটি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি ফররুখ আহমদকে চাকরীতে পুনর্বহাল করার নির্দেশ দেন। একটি বাড়িও কবি ফররুখ আহমদকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ফররুখ আহমদের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার বাড়িটির মালিকানা ভোগ করতে পারবেন কিনা – সে ব্যাপারে উদ্বেগে ছিলেন ফররুখস্বজন এবং হিতাকাক্সক্ষীরা। কবি তালিম হোসেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে সুপরিচিত তৎকালীন চবি উপাচার্য আবুল ফজলকে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর নিকট উপস্থাপনের অনুরোধ করেন। আবুল ফজল লিখেছেন, “ফররুখ আহমদের বাড়িটা তাঁর পরিবারের নামে বরাদ্দ করে দিতে আর তাঁর পরিবারবর্গকে কিছু আর্থিক সাহায্য দানের অনুরোধ করলাম (বঙ্গবন্ধুকে)। সচিবকে বলে দিলেন আমার এ অনুরোধটিও টুকে রাখতে। পরে জেনেছি এ দুই অনুরোধ শেখ সাহেব রেখেছেন অর্থাৎ বাড়িটি ফররুখের ছেলের নামে অ্যালট করে দিতে বলে দিয়েছেন এবং ফররুখ আহমদের পরিবারকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তবে তাঁর প্রথম নির্দেশটা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের গাফিলতির জন্য আজো নাকি বাস্তবায়িত হয়নি।
(শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি- আবুল ফজল, পৃষ্ঠা নং ৪৩)
বঙ্গবন্ধুর কবি-সাহিত্যিকপ্রীতি থেকেই জেল হতে মুক্তি পাবার পর আল মাহমুদকে ডেকে পাঠান এবং শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরী গ্রহণের আদেশ দেন। এ ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার চোখের অবস্থা কেমন। এতে আমি বুঝতে পারলাম আমার জেল জীবনের অনেক খুঁটিনাটি অসুবিধার দিকগুলো তাঁর অজানা ছিলো না। তিনি সহসা পকেট হতে তিন হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, আগে পরিবারটা ঠিক কর। আর আমি ইউসুফ আলীকে বলে দিয়েছি। তুই শিল্পকলা একাডেমিতে জয়েন করবি। তোর শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি ওয়েভ করে তোকে আমি সেখানে পাঠাচ্ছি।
আমি হাতজোড় করে বললাম, আমাকে আমার পেশায় রাখলে হয়তো ভালো হতো।
তিনি এতে অসম্মতি প্রকাশ করে বললেন, আমি যা বলি তাই কর।”
(আত্মজৈবনিক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩৬০-৩৬১)
অবশ্য আল মাহমুদকে শিল্পকলায় চাকরী দেবার বিষয়ে তৎকালীন শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক মোস্তাফা নূরউল ইসলাম কবির শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রসঙ্গ টেনে আপত্তি জানিয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু মোস্তাফা নূরউল ইসলামকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, কবিদের কোন ডিগ্রি লাগে না।
এই বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর লেখা “ইতিহাসের রক্তপলাশ: পনেরোই আগস্ট” গ্রন্থে বিস্তারিত লিখেছেন।
সমালোচনা হয়, যে বঙ্গবন্ধু আল মাহমুদকে চাকরী দিলেন, তিনি সেই বঙ্গবন্ধুর কোন প্রশংসা কোনদিন করেননি। এটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে খুবই নির্মম নির্দয়ভাবে খুন করা হয় তখন আল মাহমুদের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো দেখুন,-
“আমি শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর হৃদয়বিদারক জীবনাবসান ঘটে গেল। আমাদের ঘরে, পরিবারে এতে এক ক্রন্দন ধ্বনি উত্থিত হয়। আমার ছেলেমেয়ে, বউ-বাচ্চা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। -আমার হৃদয়টা হাহাকারে ভরে গিয়েছিল। সব সময় মনে হতো কোথাও পালিয়ে যাই।”
(আত্মজৈবনিক রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা নং ৩৬১)
এই রচনাবলীর অনেক পৃষ্ঠায় কবি বার বার স্বীকার করেছেন, আমি এবং আমার পরিবার বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। অনেক সাক্ষাতকারেও কবি অকপটে তা স্বীকার করেছেন। এই আত্মজৈবনিক রচনাবলী বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় দৈনিক নয়া দিগন্তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। আমি প্রতিদিন উন্মুখ হয়ে থাকতাম পরের পর্ব পড়ার জন্য। আল মাহমুদ সুবিধাবাদী হলে কী এটি সম্ভব হতো?
আর “নিশি ডাক” যদি সুবিধাবাদী চিন্তা-চেতনা হতে লিখতেন, তবে তিনি কোথাকার আলালের ঘরের সুবিধাবাদী দুলালের মাধ্যম হয়ে বেবী মওদুদ হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে যেতে হবে কেন! অন্য তোষামুদেদের মতো নিজেই যেতে পারতেন! আল মাহমুদ তো এমন হালকা নাম নয় যে, এদেশের কোন নেতার সাক্ষাতপ্রার্থী হলে সাক্ষাতে ব্যর্থ হতেন!
হাস্যকর বিষয় হলো, কেউ কেউ আবার কবিতাটির ক্রেডিটও দাবি করছেন! একজন কবির রচিত কবিতায় আনওয়ান্টেড ক্রেডিট দাবি করা কী বিকৃত মস্তিস্কের পরিচায়ক নয়?
একশ্রেণির অসাধুচক্র মনে করে, আল মাহমুদের বিরোধীতা করলে প্রচার পাওয়া যাবে, ফেমাস হওয়া যাবে। তারা সেই আশা নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে, কিন্তু গণমানুষকে আল মাহমুদের সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে এক পিসই আছে।